চর্বিত নির্য্যাস (২) : মীর লিয়াকত
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৩ এপ্রিল ২০২০, ৬:২৯ অপরাহ্ণসরকার ঘোষণা করেছে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন ঠেকাতে মসজিদে প্রতিদিনের নামাজে পাঁচজন এবং শুক্রবারের জুম্মার নামাজে দশ জন যেতে। ৯০ ভাগের বেশি মুসলমানের দেশে সরকার জানে মসজিদে যাওয়া নিষিদ্ধ করা যায় না। তাই যাতে নামাজ মসজিদে অন্তত সীমিতভাবে হয় তার জন্যই এই নিয়ন্ত্রন। এতে মসজিদ থেকে করোনা ভাইরাসের সংক্রমন সম্ভাবনা কমে যাবে, এবং মসজিদে নামাজের ধারাবাহিকতাও বিঘিœত হবে না। কিন্তু জাতির বিবেক বলে প্রচারিত আমাদের দেশের এক শ্রেনীর সাংবাদিকরা কি কাজটি করলেন? তারা পড়ি মরি করে ছুটে গেলেন মসজিদে নিউজ কাভারের উদ্দেশ্যে। মসজিদে ঢুকে ইমামের সামনের দিকে গিয়ে ক্যামেরার স্তুপ নিয়ে দশ জন মুসুল্লির ছবি তুলতে থাকেন পালা করে। আমার তো মনে হলো ইয়েমেনের যুদ্ধক্ষেত্রে নিউজ কাভারের জন্য উপস্থিত হয়েছেন তারা। সত্যি সত্যি যদি তাদের সিরিয়া ইয়েমেনে পাঠানো হতো তাহলে যে কী হতো সেটা এখানে উল্লেখ না করলেও পাঠক বুঝতে পারবেন অনায়াসে।
এই যে সাংবাদিক দল মসজিদে ঢুকলেন তাদের অনুমতি দিয়েছে কে? তারা কি অনুমতি নিয়েছিলেন? মসজিদের ইমাম এদের ঢুকতে দিলেনই বা কেন? তারা কি মসজিদের পবিত্রতা রক্ষায় ওযু করে ঢুকেছিলেন? আজকালকার কিছু ‘কপি পেষ্টিং’ সাংবাদিকতার যুগে আমাদের দেশে দশ জন মানুষের ছবি বা ফুটেেেজর জন্য এই অবস্থার সৃষ্টি করতে হবে তা সত্যিই অকল্পনীয়। কারো কারো পায়ে নাকি জুতাও ছিলো। এই যদি হয় তাহলে ? কোন অবস্থায়ই কাজটা তারা ভালো করেননি। সামাজিক মাধ্যমে প্রচারিত হওয়ায় বিষয়টি খুবই দৃষ্টিকটু মনে হয়েছে সবার কাছে।
এতে কারো দ্বিমত থাকার কথা নয় যে সাংবাদিকরাই দেশের প্রকৃত বিবেক। তারা নিজের জীবন বিপন্ন করে দেশের সেবা করেন। কিন্তু একটি শ্রেনী যদি এসব কাজ করেন তাহলে এরাই বদনামী করবেন গোটা সাংবাদিক সমাজকে। এটা কোথাও কোনভাবে গ্রহনযোগ্য নয়। ফুটেজ বা ছবির জন্য এভাবে মসজিদে ঢোকাকে এক ধরনের হামলাই বলা চলে। এসব কারনে মুসল্লিদের মনে বিরুপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হওয়া অমুলক নয়। এসব ক্ষেত্রে অত্যন্ত যৌক্তিক ও মানবিক আইন করেও সরকার খামাখাই সমালোচিত হয়। অথচ মানুষের জীবন বাঁচাতে সরকার সময়োপযোগী পদক্ষেপ গ্রহন করে।
সবাই সামাজিক মাধ্যমে এইসব সাংবাদিকদের তীব্র সমালোচনা করেছেন। বলেছেন, এই মহাসংকটের সময় তাদের মসজিদে এসে ক্যামেরার মহড়া না দিয়ে ছুটে যাওয়া উচিত ছিলো করোনায় মৃত কিংবা সংক্রমিত সানুষের খোঁজ খবরের নিউজ করতে। তাদের নিউজে যদি একজন মানুষেরও উপকার হয় প্রাণ বাঁচার সম্ভাবনা জাগে সেটাই হবে সেই সাংবাদিকের জীবনের বড় পাওয়া। এখানে মসজিদের ভেতরে মসজিদের পবিত্রতা নষ্ট না করে মানুষের প্রত্যক্ষ সেবা ও খবর সংগ্রহে ছুটে যাওয়াই কি অধিক ভালো নয়? সাংবাদিকরা তো হবেন সর্বদাই জনমুখি।
একটা পরিসংখ্যানে দেখা গেলো দেশে করোনা রোগীর সংখ্যা ১১২ জন আর ত্রাণ আত্মসাতের অপরাধে গ্রেফতার ২০৮ জন! অন্যান্য সময়ের কথা না হয় বাদ দিলাম, তাই বলে বিশ^ব্যাপী এই মৃত্যু মিছিলের সময় এটা সম্ভব? এই চাটার দলই আমাদের দেশটাকে সর্বসান্ত করে তুলছে। এজন্যেই বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন,
‘আমি বিদেশ থেকে ভিক্ষা করে আনি, আর চাটার দল সব খেয়ে ফেলে!
আমার গরীবেরা খেতে পায় না।’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বলেছেন,
‘ এই ত্রান প্রকৃত গরীবদের জন্য। এই দুঃসময়ে গরীব মানুষেরা যেন বঞ্চিত না হয়।’
কিন্তু তারপরেও অতি লোভীদের গ্রাস থেকে ত্রান রক্ষা করা যাচ্ছে না। এই সব ত্রান চুরি ডাকাতির সাথে কেবল চেয়ারম্যান মেম্বাররা জড়িত তা নয়, স্থানীয় প্রভাবশালী সরকার দলীয় লোকজনও জড়িত বলে টেলিভিশন ও পত্র পত্রিকার খবরে উঠে এসেছে। এই মহাসংকটের সময় এসব গর্হিত কাজগুলি কোনভাবেই মেনে নেয়া যায় না।
অবস্থার নাটকীয় কোন মোড় না নিলে সরকারী বিধি কঠোরভাবে মেনে না চললে লক্ষাধিক মানুষ তো আমাদের দেশেও মারা যেতে পারে। দিন মজুর শ্রমিক ক্ষুদ্র পেশার বেকার মানুষেরা এখন হঠাৎ বেকার হয়ে পড়েছে। তার উপর কোয়ারেন্টাইনে থাকতে গেলে তাদের সংসার চলবে কি করে। দেশের এই দুরবস্থার কথা মাথায় রেখে প্রধানমন্ত্রী অনতিবিলম্বে ত্রানের ব্যবস্থা করে দিয়েছেন। এটাও যদি তাদের কাছে সঠিকভাবে না পৌঁছায় তাহলে এই হতদরিদ্র মানুষ ঘরে থাকবে কি করে? আর ঘরে থাকলে তারা খাবে কি? খেতে না পেয়ে মরার চেয়ে করোনায় মরাই তাদের কাছে উত্তম পথ। প্রধানমন্ত্রী কি সবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে মাথায় করে ত্রাণ পৌঁছাবেন? সীমিত সম্পদ নিয়ে সরকার আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছে। তাহলে এসব জনপ্রতিনিধিদের কেন ভোট দিয়েছে মানুষ? ভোটের সময় তো এরা দ্বারে দ্বারে যেতে পারে, কিন্তু ত্রাণের সামগ্রীটা বাড়ি বাড়ি পৌঁছাতে পারে না। এই ত্রাণ তো তারা নিজেদের পকেট থেকে দিচ্ছে না। সরকারী মাল পেলেই এরা কান্ডজ্ঞানহীন হয়ে যায়। এ সময় এই চাটার দলকে সনাক্ত করে তাদের জাতির সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব সাংবাদিকরা পালন করতে পারেন। সাংবাদিকরা এই অবস্থা জাতির কাছে তুলে ধরলে সরকারই শুধু নয় দেশের জনগন তা মূহুর্তে জেনে যেতে পারে। অন্য কোন মাধ্যমে দ্রæত চোখের সামনে এসে পোৗঁছায় না। এখানেই সাংবাদিকদের কৃতিত্ব। জাতির জন্য এখানেই তারা সবচেয়ে বড় ভ’মিকা পালন করেন।
নিজেদের আত্ম সমালোচনা না করলে অন্যের সমালোচনা করা যায় না। আমরা যারা সাংবাদিকতা করি আমরা যে সব সমালোচনার উর্দ্ধে এটা ভাবার কোন অবকাশ নেই। তাই আত্মসমালোচনা অবশ্যই প্রয়োজন। তেত্রিশ চৌত্রিশটি টিভিতে একই নিউজ, একই ছবি। শোনা যায় কেউ কেউ বলেন বানান একটি ভুল হলে নিউজ এডিটরের চোখে না পড়লে ভুল বানানটাই সবখানে একই সাথে যায়। এটা হবে কেন? আমাদের দেশের সাংবাদিকদের মেধা মণণের কি কোথাও ঘাটতি আছে? নেই । তবে এমন হবে কেন? অন্য কোন সময়ের কথা নয়, কথা চলমান এই মহাসংকটের সময় সাংবাদিকরা অনন্য ভুমিকা পালন করতে পারেন।
এই দেশ আমেরিকা ইউরোপের কোন দেশ নয়। আমরা যতোই বলি আমাদের দীনতা আছে। ইচ্ছা করলেই আমরা সব কিছু পারি না। মহা দুর্যোগের এই সময়ে মসজিদে কজন নামাজ পড়লো সেটার ফুটেজ না দেখে প্রয়োজন কোথায় কোন করোনা রোগী হাসপাতালে যেতে পারছে না, কাদের ঘরে খাবার নেই বিরান এলাকাগুলো সরকারের চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখানো, যাতে সরকার তাৎক্ষনিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহন করতে পারেন। সাংবাদিকরা যে করছেন না এটা কিন্তু ঠিক নয়। করোনা ভাইরাসের শুরু থেকে সাংবাদিকরা কাজ করছেন জীবনের ঝুঁকি নিয়ে। যতোটা না পেশায় ততোটা নেশায়। কোন ইকুয়িপমেন্ট ছাড়া অরক্ষিত অবস্থায়ও তার দেশ জনতার স্বার্থে ছুটছেন। এমনকি পেশাগত দায়িত্ব পালন করতে গিয়ে আক্রান্তও হয়েছেন। তাদের এই নিঃস্বার্থ অবদান অবশ্যই অনস্বীকার্য। জাতির বিবেক তো জাতির স্বার্থেই কাজ করবেন আর এটাই কাঙ্খিত।
আগেই বলেছি এই দেশ ইতালী, স্পেন কিংবা কানাডা নয়। জাস্টিন ট্রুডো কানাডায় কি করেছেন সেটা আমাদের দেশে প্রযোজ্য নয়। যদি ট্রুডো এদেশে থাকতেন তাহলে টের পেতেন হাড়ে হাড়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার সীমিত অবস্থান নিয়ে যতোটুকু করতে পারছেন সেটা চেষ্টা করলেও অন্যদের দ্বারা সম্ভব নয়। কানাডার মানুষ আর আমাদের মানুষ এক নয়। সরকার চেষ্টা করেও মানুষকে ঘরমুখো করতে পারছে না। সরকার ত্রাণ পাঠাচ্ছে উপোষী মানুষের জন্য, আর জনপ্রতিনিধিরা এই মহাসংটের সময়ও তা বেমালুম হজম করে যাচ্ছে। কানাডা নিউইিয়র্কে এসব কি সম্ভব?
আমার মনে আছে প্রথম সেই সত্তরের দশকে সাংবাদিকতা শুরুর সময় দেশের প্রাচীনতম দুটি পত্রিকা যুগভেরী ও আজাদের মাধ্যমে শুরু করেছিলাম। সত্তরের দশকের প্রথমার্ধে স্বাধীনতার উষালগ্নে যুগভেরীর সম্পাদক ছিলেন তখন প্রয়াত পররাষ্ট্র মন্ত্রী হুমায়ুন রশীদ চৌধুরীর সহোদর আমীনুর রশিদ চৌধুরী। একটা নিউজ নিয়ে একবার তার আম্বরখানাস্থ রশীদমঞ্জিলে তিনি ব্রিফ করেছিলেন, কুকুর মানুষকে হঠাৎ কামড় দিলে সেটাকে নিউজ মনে না করে কোন মানুষ কুকুরকে কামড়েছে কিনা সেই খবর নিতে হবে, সেটাই নিউজ। যথার্থ বলেছিলেন এই প্রাজ্ঞ সম্পাদক। মসজিদের সেই দশজনের নামাজের নিউজ থেকে কোন মসজিদে সরকারী বিধি না মেনে নামাজ হচ্ছে অর্থ্যাৎ সেখান সামাজিক দুরত্ব না মেনে ভাইরাস সংক্রমিত হবার সম্ভাবনা ছিলো কি না সেই নিউজটাই হতো গুরুত্ববহ। আইন মেনে দশ জন তো নামাজ পড়ছেনই, সেটা নিউজ করার কোন প্রয়োজন ছিলো কি? কারন করোনা ভাইরাসের গতিপ্রকৃতিই এরকম। যে কোন শর্তে দুরত্ব বজায় রাখতেই হবে, ঘরবন্দী থাকতেই হবে।
সময় বয়ে যাচ্ছে। বিশে^ সবচেয়ে ভয়ঙ্কর অবস্থানের বাইরে আমরাও নই। সামনে আমাদের ভাগ্যে কি আছে আমরা জানি না , জানে না কেউ। এখন যে স্টেজ আমরা পার করছি তা যে কতোটা ভয়ংকর হয়ে উঠতে পারে তা আমরা যে কেউ এখন হৃদয়ঙ্গম করতে পারছি। এখানেও লক্ষ মানুষের জীবনহানির সম্ভাবনা রয়েছে। প্রথমে জেনে শুনে প্রবাসীদের অপরিকল্পিতভাবে দেশে আসা, পরে স্কুল কলেজ ছুটি পেয়ে অবারিতভাবে বিনোদনে সবার ঈদের আমেজ গ্রহণে বোকার মতো ঘুরতে বেরিয়ে পড়া, সবশেষে গার্মেন্টস এর বিচ্ছিরি মিছিল না হলে আমাদের ভয় বহুলাংশে কম হতে পারতো। তবে আশার আলো দেখাই ভালো। হতাশায় আরো আয়ু কমে। টিম টিম একটা আশার আলোর কথা শুনলাম, জানি না কতোটুকু সঠিক। জাপান নাকি ইতোমধ্যেই করোনার ভ্যাক্সিন আবিস্কার করেছে এবং অচিরেই তারা তা অবিলম্বে বাজারজাত করছে। এটা যদি সঠিক হয়ে থাকে তাহলে হয়তো আমরা বহু মৃত্যু থেকে ¯্রষ্টার অপার মহিমায় রেহাই পেলেও পেতে পারি। আর দিন পনেরোর মধ্যেই পবিত্র রমজান মাস শুরু। এর আগেই যদি ভ্যাক্সিন সহজলভ্য হয় তাহলে হয়তো আমাদের এই সংকট থেকে বের হওয়া সম্ভব। দুিশ্চন্তাহীনভাবে পবিত্র রোজায় মুসুল্লিরা তারাবীহ মসজিদে যথারীতি পড়তে পারবেন। আর যদি না হয় তাহলে খতম তারাবীহ পড়া সম্ভব নাও হতে পারে। পড়তে হবে বাসায় থেকেই সুরা তারাবীহ।। এসবই হলো আশার কথা।
আরেকটা আশার কথাও শোনা গেলো। বাংলাদেশে ৯৯.৬% এর বিসিজি টিকা দেয়া আছে। ১৯৭৯ সাল থেকে এই টিকা দেয়া হয়। এক গবেষনা থেকে জানা যায় এই বিসিজি টিকা দেয়া থাকলে শরীরে করোনা ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে না। এই টিকা আমেরিকা ইউরোপের কোন দেশে দেয়া হয়নি বলে ওখানে প্রকোপ বেশি বলেও গবেষনায় উল্লেখ করা হয়। বলা হয়ে থাকে গরীব দেশসমুহেই এসব টিকা দেয়া হতো। ধনী দেশে এসব টিকা দেয় হতো না, তারা নিতো ও না। তাছাড়া উষ্ণতার দিক দিয়েও আমাদের দেশ বহুলাংশে সুবিধাজনক অবস্থায় আছে।
অবশ্য পাকিস্তানী আমলে আমার নিজেরও টিকা দেয়া আছে কিন্তু সেটা কিসের টিকা এখন আর মনে করতে পারছি না। দুটি টিকা নিয়েছিলাম বাম বাহুতে। ছোট বৃত্তাকার কাটা কাটা যন্ত্র দিয়ে ঘুরিয়ে এই টিকা দেয়ার সময় মনে আছে ভয়ে খুব চিৎকার করেছিলাম। সিলেট ওসমানী মেডিক্যাল কলেজের সাবেক পরিচালক বিশিষ্ট চিকিৎসক ডাঃ শফিকউদ্দিন আহমেদ এর কাছে এ ব্যাপারে জানতে চেয়েছিলাম, তিনি জানালেন পঞ্চাশের দশকে তিনিও দিয়েছেন টিকা কিন্তু সেটা নাকি খুব সম্ভবত ছিলো গুটি বসন্তের টিকা, বিসিজি নয়। রিটায়ার্ড বিশিষ্ট ব্যাংকার সিএম শফি সামি আমার অত্যন্ত প্রিয়ভাজন। অসাধারন একজন বুদ্ধিজীবি তিনি। তাকে এ ব্যাপারে জিজ্ঞেস করেছিলাম, তিনি জানালেন তিনি ১৯৫৬ সালে তার চার ভাই ও এক বোনসহ জামালপুরে এই টিকা নিয়েছিলেন এবং সেই টিকাটি ছিলো বিসিজি টিকা। তার ভাইয়েরা হলেন সাবেক তত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা সিএম শফি সামি, জালালাবাদ এসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি সিএম তোফায়েল সামি, আমেরিকায় অবস্থানরত আরেক ভাই সিএম হায়াৎ সামি এবং বোন ফওজিয়া এনায়েত সুমি। তাদের বাবা তখন জামালপুরের মুন্সেফ হিসেবে কর্মরত ছিলেন। হতে পারে সে সময়ে দেয়া এই টিকা বিসিজি ছিলো। আর ১৯৭৯ সাল থেকে তো দেয়া আছেই। যদি হয় তাহলে তো ভালোই।
যাক সে কথা। এসবই আশার কথা। আশার কথা কার না ভালো লাগে। এই মহাতংকের সময় এটা কিছুটা হলেও হয়তো স্বস্থি দেবে, কিন্তু বৈশি^ক প্রেক্ষাপটে অবস্থা তো ভিন্ন। এ ধরনের ¯্রষ্টা প্রদত্ত সুযোগ না থাকলে আমাদের দুরবস্থার অন্ত থাকবে না। এমনও তো হতে পারে এ ধরনের সম্ভাবনা গুলো থেকে আমরা হয়তোবা সংকট কাটিয়েও উঠতে পারি। এই লেখা তৈরী করার সময় এক বন্ধু ফোনে বললেন, বাঙালিদের কঠিন জীবনপ্রনালীর মধ্যে আসলে জীবানু নিয়েই আমাদের বসবাস। সর্বত্র চোখ মেলে তাকালে তাই দেখা যায়। জীবনসংগ্রামে জীবানু আধিক্য ছাড়া আমাদের বসবাস সম্ভবই নয়। বিভিন্ন স্থানে যে দরিদ্রসীমার নীচে মানুষ যেভাবে বসবাস করে সেখানে আসলে জীবানুর শেষ নেই। তবু ¯্রষ্টার অপার কৃপায়ই তারা বেঁচে আছে। এটাও আমাদের একটি আশার কথা। আসলে যে যাই বলুন বাঙালিরা কিন্তু সহজ সরল হিসেবে পরিচিত একটি জাতি। বলা হয়ে থাকে সহজ সরল মানুষকে ¯্রষ্টাই তার অপার করুনা নিয়ে দেখেন।
প্রসঙ্গক্রমে ছোট্ট একটা গল্প এখানে উল্লেখ করতে চাই। এক রোগী একবার ডাক্তার দেখাতে গেছেন। ব্যস্ত ডাক্তার রোগীকে পরীক্ষা নিরীক্ষা করে তার অসুবিধার কথা শোনার পরে বললেন,
‘আপনার মেদ বেড়ে গেছে। প্রেসারও খুব বেশি। এখন থেকে দুবেলাই রুটি খাবেন। আর এই অষুধগুলো লিখে দিলাম নিয়মিতভাবে খাবেন।’
রোগী কি যেন বলতে চাইলো, কিন্তু ব্যস্ত ডাক্তার ততক্ষনে আরেকজন রোগী নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ায় আর কিছু বলা হলো না। প্রেসক্রিপশন হাতে নিয়ে রোগী অগত্যা ডাক্তারখানা থেকে বাইরে এসে কি যেন ভাবতে থাকে। কিছুক্ষন পর সে আবার রোগীর ভিড় ঠেলে ডাক্তারের সামনে এসে দাঁড়ালো। ডাক্তার তাকে দেখে বললেন,
‘কি ব্যাপার আপনি আবার ফিরে এলেন যে? আপনাকে তো সব বলেই দিয়েছি।’
রোগী এবার আমতা আমতা করে বললো,
ডাক্তার সাহেব, ‘আমি একটা কথা বলতে চাই।’
‘ঠিক আছে বলুন কি বলতে চান।’
‘ডাক্তার সাহেব, আপনি যে বললেন রুটি খেতে, কিন্তু জেনে নিতে ভুলে গিয়েছি রুটি আমি যে খাবো
সেটা কি ভাত খাবার পরে রুটি খাবো না ভাত খাবার আগে।’
ডাক্তার আর কি বলবেন। তিনি তো থ’। রুটি যে ভাতের বদলে খাবে এটা সেই রোগীর কল্পনারও বাইরে। তার মানে তার কাছে খাবার হিসেবে ভাতটাই আসল। আসলে মাছেভাতে বাঙালি এমনই। খাবার দাবার ব্যাপারেও তারা এমনি সহজ সরল। বর্তমান সময়ে অবশ্য কালের বিবর্তনে অনেক কিছুই পাল্টে গেছে। কিন্তু নানা অসচেতনতা এখনো তাদের ঘিরে আছে। অসচেতনতা আছে বলেই পুলিশ আর্মী দিয়েও তাদের ঘরমুখি করা যাচ্ছে না। দুএকদিন যারা ঘরে থাকছেন তার পরদিনই বাইরে এসে দেখে যেতে চায় পুলিশটুলিশ আছে কি না। না থাকলে দোকানের দিকে এগিয়ে গিযে কোন কাজ টাজ ছাড়াই এক কাপ চা খেতে গিয়ে কিছুক্ষন গল্পেসল্পে কাটিয়ে দেয়া তাদের জন্য কোন ব্যাপারই নয়। আবার পুলিশ দেখলে এক ছুটে ঘরে পালিয়ে যাওয়া। এ যেন এক ধরনের লুকোচুরি। করোনার মতো ভয়ংকর ব্যাধির গতি প্রকৃতি বোঝালেও তারা হাসি টাট্টায় উড়িয়ে দিতে অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। তাদের ধারনা এসব সর্দিকাশির রোগ তাদের জন্য কিছুই নয়। এসব তো হরহামেশা হচ্ছেই। আমলেই নিতে চায় না এই মারনব্যাধির ভয়াবহতা।
লেখাটা শুরু করেছিলাম মসজিদের নামাজ নিয়ে। শতকরা নব্বই ভাগ মুসলমানের এই দেশের জনগন নিজ ধর্ম পালনে যেমন সিরিয়াস ঠিক তেমনি অন্য ধর্মের প্রতিও রয়েছে তাদের সহনশীলতা। তাই বাংলাদেশ এখন বিশে^র অন্যতম শ্রেষ্ঠ সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির দেশ। করোনার তান্ডব থেকে রেহাই পেতে সরকার মানুষকে বাঁচাতে সামাজিক দুরত্ব বজায় রাখার অংশ হিসেবে মসজিদে না গিয়ে ঘরে নামাজ আদায় করার আহŸান জানিয়েছে। কিন্তু দেখা গেছে জুম্মার নামাজ আদায় করতে আট দশ তালার খোলা ছাদের উপরও জামাতে নামাজ আদায় করা হয়েছে। তার মানে সেনাবাহিনী নৌবাহিনী এখানে অকৃতকার্য, এখন কি তাহলে ছাদের উপর নামাজ হচ্ছে কিনা দেখতে বিমানবাহিনীকেও নামাতে হবে? এটা মূলত মানুষের ধর্মীয় চেতনা ও আবেগের ফসল এবং এটা ঠিক যে বাঙালির অসচেতনতা সব সময়ই বেশি। তার মানে এই নয় যে বাঙালি চির অসচেতন! প্রয়োজনের সময় তারা যে কোন পরিস্থিতিতে বিশাল চমকও দেখাতে পারে। একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ তার বলিষ্ঠতম নজীর। সময় একটু বেশি লাগলেও বাঙালি ¯্রষ্টার নাম নিয়ে করোনাকেও মোকাবেলা করতে পারবে। ঐতিহ্য অনুযায়ী এই আশা করাটাও অমুলক নয়।
এখন আমাদের যা করতে হবে তা হলো কোন অবস্থায়ই বাইরে চলাফেরা করা যাবে না। সরকারী বিধিবিধানকে কঠোরভাবে মেনে চলা ছাড়া আমাদের আর কোন পথ খোলা নেই। মনে করতে হবে এটাই আমাদের একমাত্র প্রতিষেধক। হ্যাঁ, নি¤œবিত্তদের জন্য ঘরে থাকাটা হবে সবচেয়ে কষ্টকর। সরকার এ ব্যাপারে ব্যবস্থা নিচ্ছেন। কিন্তু সেদিকে চেয়ে না থেকে সমাজের বিত্তবানদের সবাইকে সামর্থ্য অনুযায়ী এগিয়ে আসতে হবে। এতে কোনক্রমেই অবহেলা করা যাবে না। আর সচেতনতার বিষয়ে সাংবাদিকরা গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখতে পারেন নিঃসন্দেহে। কারন সাংবাদিকদের উপর জাতির প্রত্যাশা অনেক। তারা করেও যাচ্ছেন, তারা সফল হোন। দেখা যাক আমরা সীমিতি অবস্থান নিয়ে কোথায় গিয়ে দাঁড়াতে পারি। ¯্রষ্টা আমদের সেই করুনা ভিক্ষা দিন, আমরা যেন করোনাকে মোকাবেলা করতে পারি।
লেখক: সব্যসাচী লেখক