চর্বিত নির্যাস (৩)

পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ এপ্রিল ২০২০, ৪:৩৮ অপরাহ্ণআজ লিখতে বসেই মনটা ভারাক্রান্ত! চারিদিকে লাশের মিছিলের সাথে লন্ডনে আমার ছোটবোনের স্বামী আব্দুস সাত্তার করোনা আক্রান্ত হয়ে ইন্তেকাল করেছেন (ইন্নালিলাহি ওয়াইন্না ইলাইহি রাজিউন)। তিনি আনু মিয়া নামে সুপরিচিত ছিলেন। ষাট বছর থেকে তিনি নিজে লন্ডনে প্রবাসী। পরিবারের অন্যরা আরো আগের। একমাত্র ছেলে ও দুইমেয়ে এবং স্ত্রী (আমার ছোটবোন) নিজেদের পরিবারবর্গসহ তাকে লন্ডনেই। অপর দুই মেয়ে তাদের পরিবারবর্গসহ থাকে ঢাকায়। ছেলে, দুই মেয়ে এবং স্ত্রী বাসায় বসে ছটফট করলেও শেষ দেখাও দেখতে পারেননি। শুধু ছেলেটি বহুদূর থেকে লাশ দাফন দেখতে পেয়েছে। সে এক মর্মান্তিক দৃশ্য ছিলো যা পরে তাদের পাঠানো ছবিতে দেখেছি, দেখেছি টেলিভিশন নিউজে। লন্ডনে শত শত বাংলাদেশী মৃত্যুবরন করছেন করোনাক্রান্ত হয়ে। লল্ডনেও ভালোভাবে বাঙ্গালীরা কোয়ারেন্টাইন মানছেন না, মানছেন না আইসোলেশন। বাইরে বাইরে অহেতুক চক্কর দেয়া তাদের অভ্যাস। এই তো গত কয়েকদিন আগে ফেসবুকে দেখলাম লন্ডনে দেকানে পান খেতে গিয়ে মারামারি করছেন বাঙ্গালীরা। বড় দূর্ভাগ্যজনক! আমার ভগ্নিপতি অবশ্য কয়েক বছর যাবৎই বৃটিশ সরকারের তত্বাবধানে চিকিৎসাধীন ছিলেন। তার বয়স হয়েছিলো ৮০ বছর। মৃত্যুর আগের দিন তার করোনা ধরা পড়ে। সাথে সাথে অস্বাভাবিক শ^াসকষ্ট তাকে মৃত্যুর দুয়ারে ঠেলে দেয়। এই হাসপাতালেই বেশ কয়েকজন করোনায় আক্রান্ত ছিলেন।
বিশ^ জুড়ে এই মারনব্যাধি লক্ষ প্রাণ কেড়ে নিয়েও তার বধযজ্ঞ অব্যাহত রেখে চলেছে। বিশে^র হাতে গোনা কয়েকটি রাষ্ট্র ছাড়া গোটা বিশ^ই দখলে নিয়ে নিয়েছে করোনা ভাইরাস। এখনো যার প্রতিষেধক আবিস্কার করতে পারেনি বিশে^র কোন দেশ, যদিও আশার আলো দেখাচ্ছে যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্র চীন। চীনের উহান থেকে শুরু হলেও চীন কিন্তু নিজেদের সামলে নিয়েছে ইতোমধ্যে। নিজেদের সামলে নিয়ে তারা যুক্তরাষ্ট্র যুক্তরাজ্যসহ অন্যান্য দেশে পাঠাচ্ছ চিকিৎৎসা সরঞ্জাম। যুক্তরাষ্ট্রের সেরা এ্যন্টিবায়োটিকের বাজার এখন চীনের দখলে। মাক্স পিপিই স্যানিটাইজার অষুধ খাবার তারাই পাঠাচ্ছে। লকডাউণ আইসোলেশন টেষ্ট ইত্যাদির যে ফর্মূলা তারা দিয়েছে সেই পথেই হাঁটছে গোটা বিশ^। মনে হয় করোনার মাধ্যমে আগামীর বিশ^ নেতৃত্বের পথেই হাটছে তারা। বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার দেয়া ফর্মুলাও চীনকে অনুসরন করছে। এই ফর্মুলাই অনুসৃত হচ্ছে তাবৎ বিশে^।
বাংলাদেশ ছোট্ট একটি দেশ। কিন্তু অত্যন্ত ঘনবসতিপূর্ণ। ঘনবসতিপূর্ণ এরকম দেশ করোনার জন্য ভয়ংকর। কারন এখানে দূরত্ব বজায় রাখার মতো সুযোগ খুবই কম। আর প্রতিষেধক আবিস্কার না হওয়া পর্যন্ত দুরত্ব বজায় রাখাই একমাত্র মহৌষধ। নিজেদের সামলে নেয়ার জন্য বাংলাদেশের সরকারও বিশ^ স্বাস্থ্য সংস্থার বিধি নিয়ম মেনে চলে মানুষকে ঘরবন্দী রাখার যে চেষ্টা করছে তা আমলে নিচ্ছে না মানুষ। সরকারী হিসেবে আট মার্চ শুরু হয়ে আজ ২১ মার্চ মৃতের সংখ্যা পৌঁছেছে একশত এক এ। সবচেয়ে দুৎখজনক যেটি সেটি হলো করোনার তথ্য গোপন করে আমাদের দেশে চিকিৎসকদের আক্রান্ত করা হচ্ছে। আজ বিয়ালিশজন চিকিৎসকই শুধু আক্রান্ত হয়েছে। এখনো পচিশ ভাগ চিকিৎসক তাদের সুরক্ষা সরঞ্জামই পাননি। ষাটভাগ স্বাস্থ্যকর্মী এখনো পাননি তাদের সুরক্ষা সরঞ্জাম। অথচ এই স্বাস্থ্য কর্মীরা চিকিৎসকদের পরেই পালন করেন গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। কোন ভরসায় তারা দেবেন চিকিৎসা সহায়তা?
রাতারাতি চীনের সামলে নেয়ায় কিন্তু বড় ক্রেডিট সে দেশের জনগনের এবং সর্বমহলের। রাতারাতি হাসপাতাল নির্মানসহ প্রয়োজনীয় অন্যান্য সুযোগ সুবিধা নিশ্চিত করতে চীনের বড় হাতিয়ার ছিলো সে দেশের জনগন। বাংলাদেশের মানুষ সেই পথে হাটতে চাইছে না। সিলেটের কথাই ধরি। পত্রিকায় প্রকাশিত খবরের তথ্য অনুযায়ী জানা যায়, সিলেটের টিলাগড়ে এক প্রাইিভেট কার আটকে পুলিশ জানতে চেয়েছিলো কেন বাইরে এসেছে। উত্তরে প্রাইভেট কারের মালিক পুলিশকে জানিয়ে দিলো সারাদিন ঘরে বসে থাকতে ভালো লাগছিলো না তাই গাড়ি নিয়ে একটু ঘুরতে বেরিয়েছেন তিনি। ছিঃ এমন কথা কি করে বললেন তিনি? তিনি যদি চারপেয়ের মতো মরেন তাহলে তো কারো কিছু যায় আসে না। কিন্তু কতো লোককে সংক্রমন করে যাবেন তিনি? অন্যের মৃত্যুর কারন হওয়া বা লাইসেন্স দেবার অধিকার কোথ্থেকে পেলেন তিনি। পুলিশই বা কেন তাকে প্রকাশ্য রাস্তায় গাড়ি থেকে নামিয়ে থানায় নিয়ে গেলো না? তিনি যদি ডাক্তারের কাছে যেতেন, অষুধ বা বাজরে জরুরী প্রয়োজনে যেতেন তাহলে না হয় একটা কথা ছিলো। মানুষ মরার মিছিলের সময় তিনি গাড়ি নিয়ে হাওয়া খাবেন এটা কেমন কথা? তিনি কি সরকারী নির্দেশ জানেন না? নাকি সরকারকে পাত্তা দিচ্ছেন না, কোনটা? সিলেটের বড় পাইকারী বাজার কালিঘাটে প্রচন্ড ভিড়। বরং এখন যেন ভিড় বেড়েছে আরো। কারনটা কি? করোনাকে তারা পাত্তাই দিতে চাইছে না। করোনা শক্তিশালী না তারা শক্তিশালী?
আগামী ২৫ এপ্রিলের পর থেকে জুনের মাঝামাঝি পর্যন্ত এই অবস্থা অপরিবির্তিত থাকলে প্রবাসী অধ্যুষিত সিলেটের কপালে কি আছে কেউ জানে না। তারা কি জানে না ডাঃ মঈনের মতো নিবেদিতপ্রাণ ডাক্তারকে সিলেটে চিকিৎসা দিতে না পেরে ঢাকায় আসতে হয়েছিলো আর তারপর প্রাণই দিতে হয়েছিলো। দেশের প্রায় সব কটি অঞ্চলেই ছড়িয়ে পড়ছে সংক্রমন। মৃত্যুবরন করলেই সেই এলাকা লকডাউনের আওতায় নেয়া হচ্ছে। লক ডাউন করা হচ্ছে না পুরো দেশ। ঢাকায় মীরপুর নারায়নগঞ্জের পর গাজীপুর এখন রেড জোন। পুরান ঢাকার কপালে কি আছে তা আলাহ মালুম। কারন পুরান ঢাকার ঘিঞ্জি এলাকায় সেখানে দুরত্ব অবলম্বন সুদূরপরাহত। সবশেষে বড়সড় ধাক্কা দিয়ে বসে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার জানাজার ঘটনা। সে কথায় আসছি পরে। ক্রমে আমরা এগিয়ে যাচ্ছি ভয়ংকর সময়ের দিকে। যে ভুলটা করেছিলো যুক্তরাষ্ট্র ও ইতালী স্পেন সহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ ঠিক সেই একই ভুল করে বসলো বাংলাদেশ। কিন্তু বাংলাদেশ সময় পেয়েছিলো অনেক। যুক্তরাজ্য যুক্তরাষ্ট্রকে দেখে তারা আগেভাগেই শিখতে পারতো, কিন্তু তা না করে তারা গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসিয়ে দিলো। দুজন হেঁটে যাচ্ছিলেন, পচাৎ করে রাস্তার ওপর থুক ফেললেন একই সাথে নাকও ঝাড়লেন। সহ্য করতে না পেরে বললাম, ‘একি করলেন ভাই, রাস্তায় এভাবে থুক ফেললেন কেন?’ উত্তরে আমাকে বললো,‘ রাস্তায় ফেলবো না তাহলে ফেলবোটা কোথায়, আপনার মুখে? গেলি…? দুজনের মারমুখি অবস্থান দেখে চুপচাপ স্থান ত্যাগ করতে বাধ্য হলাম। নয়তো চড় থাপ্পড় খেতে হতো হয়তো! হায় হতোষ্মি! আমার এক ছোটভাই বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেকুর রহমান থাকে দক্ষিনখানে। সে তার ছেলের গাড়ির কিস্তির শেষ তারিখে বাধ্য হয়ে কিস্তি দিতে গিয়েছিলো বনানীর ব্র্যাক ব্যাংকে। প্রধানমন্ত্রী এসব কাজে সুযোগ দেবার জন্য নির্দেশনা দিলেও তা মানে কে? খালেকুর রহমান এই বিষয়টি ব্যাংককে জানালেও ব্যাংক কোন সদুত্তর দেয়নি। বলে দিয়েছে এধরনের কোন নির্দেশনা নাকি ব্যাংক পায়নি। কিস্িিত দিয়ে আসার সময় সে দেখেছে রাস্তায় হেভি ট্রাফিক জ্যাম। বরং অন্যান্য দিনের চেয়ে বেশি। তাহলে কি আইন প্রয়োগকারী সংস্থা অসহায় হয়ে হাল ছেড়ে দিয়েছে? এই ছিলো মেসেঞ্জারে আমাকে দেয়া তার তথ্য। পুলিশ কি করবে? তারা তো নিজেদের জীবনের ঝুঁকি নিয়ে দিনরাত নিজেদের পুরোপুরি সুরক্ষা ছাড়াই মাঠ পর্যায়ে কাজ করছে। তাদেরও তো ঘরে মাবোন আছে। মানুষ যদি না বোঝে তাহলে তাদের করার কি আছে?
কয়েকদিন আগে ফেসবুকে একটি স্ট্যাটাস দিয়েছিলাম, লিখেছিলাম সব মারা যাবার পর ইতিহাসে লেখা হবে, ‘বাজার করার কারনে একটি বীর জাতি বিলুপ্ত!’ বলতে চেয়েছি করোনায় যদি সবাই আমরা মরে যাই তাহলে একদিন না একদিন তা হাজার বছর পরে হলেও ইতিহাসবিদরা লিখে ফেলবেন একটি বীর জাতি সচেতনতার অভাবে অহেতুক বাজারে যাবার কারনে সংক্রমিত হয়ে পুরো জাতিই বিলুপ্ত হয়েছে! ফেসবুকের স্বল্প পরিসরের স্থানে মন খুলে সব বলার সুযোগ থাকে না। থাকলে বলতাম, কোন জাতি বিলুপ্ত হলে হাজার বছর পরে হলেও বিলুপ্তির কারন উঠে আসে ইতিহাসের পাতায়। আমাদের বিলুপ্তির আসল কারনই তো বাজার করা! একজন ফেসবুক বন্ধু এই স্ট্যাটাসে মন্তব্য করতে গিয়ে বলেছেন সবই যদি মরেই যান তাহলে ইতিহাসটা লিখবে কে! আসলে কোন জাতি এভাবে বিলুপ্ত হলে অন্যরাই এই ইতিহাস গবেষণা করে ইতিহাসের পাতায় তুলে আনে। যখন এই স্ট্যাটাসটা লিখেছিলাম সে সময়ই ব্রাহ্মণড়িয়ায় জানাজার প্রসঙ্গটি দেশ জুড়ে আলোচনায় আসে। এই যে লক্ষ লোকের সমাগম হলো আর এখান থেকে নিশ্চিত যে সংক্রমন হলো তার জন্য দায়ী কে? যে হাফেজ সাহেব মৃত্যুবরন করেছেন তাঁর পক্ষ থেকে তো জানাজায় আসার কোন আমন্ত্রন জানানো হয়নি। সরকারও তা নিয়ন্ত্রন করতে পারেনি। স্বাস্থ্য মন্ত্রী তার প্রতিক্রিয়ায় স্বীকার করেছেন সরকারের ব্যর্থতা। প্রকাশ করেছেন তার হতাশা। সরকার অবশ্য সেখানকার ওসি ও এসপি সর্কেলকে সাথে সাথে তাদের ব্যর্থতার জন্য প্রত্যাহার করেছেন এবং তদন্ত কমিটি গঠন করেছেন। কিন্তু তাতে কি হবে? সংক্রমন যা হবার তাতো হয়েই গেছে। আমার বন্ধু সাংবাদিক কাজী তোফায়েল ফেসবুকে তার এক স্ট্যাটাসে লিখেছেন হাফেজ সাহেবের পর যদি আলামা শফি সাহেব ইন্তেকাল করেন তাহলে তার জানাজা কি বৈধ হবে? এটাও আসলে একটি গুরুতর প্রশ্ন!
আমার স্ট্যাটাসে আমি বোঝাতে চেয়েছিলাম যদি সত্যি সত্যিই এই দেশ একদিন করোনায় বিলুপ্ত হয় আর হাজার বছর পর যদি এই জনপদ পুনরায় আবিস্কৃত হয় তাহলে কি বাজারে অকারনে বেরুনোর জন্য সংক্রমিত হয়ে এই জনপদের সবার করোনায় প্রানহানি ঘটার খবর বেরিয়ে আসে? বেশ কিছুকাল আগে খবরের কাগজে পড়েছিলাম বাংলাদেশ নাকি একসময় তলিয়ে যাবে পানির নীচে। এই সময়ে কাগজে একটা লেখা পড়েছিলামÑ তাতে একটি বাস্তব গল্প লেখা হয়েছিলো। চর্বিত নির্যাস পাঠকদের জন্য ছোট্ট এই গল্পটা এখানে তুলে দিলাম।
দেশভ্রমনে গিয়ে একবার বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ভদ্রলোক নিজের ছেলেটাকে অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটি ঘুরিয়ে দেখাচ্ছিলেন। কিছুক্ষন ঘুরে ফিরে ছেলে বললো,
‘বাবা, আমাদের দেশের ঢাকা বিশ^বিদ্যালয় বড় না অক্সফোর্ড বিশ^বিদ্যালয় বড়?’ বাবা বললেন, ‘অক্সফোর্ড অনেক বড় বাবা।’ ছেলে আর কোন কথা বলছে না দেখে বাবা বললেন, ‘কেনÑ তুমি হঠাৎ এ কথা জিজ্ঞেস করলে কেন বলো তো?’ ছেলে উত্তরে বাবাকে বললো, ‘বাবা অক্সফোর্ড ইউনিভার্সিটির দেয়ালে কোন লেখাটেখা নেই, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের দেয়ালে কতো বড় বড় লেখা! তার মানে এদের থেকে আমরা বেশি শিক্ষিত তাই না বাবা? নিশ্চই এরা লোখাপড়া কম জানে, দেয়ালে লিখতে পারে না।’
বাবা উত্তর দিলেন না। কি উত্তর দেবেন তিনি? আপাতত মুখে কুলুপ আটাকেই বুদ্ধিমানের কাজ মনে করলেন। ফেরার পথে তিনি ভাবলেন যদি কখনো আসলেই জলবায়ুর বিবর্তনে বা অন্য কোন প্রাকৃতিক কারনে বাংলাদেশ সত্যি সত্যিই পানির নীচে তলিয়ে যায় এবং ১০০০ বছর পর পুনরায় এই দেশ পানির নীচ থেকে আবিস্কৃত হয় তবে বিজ্ঞানীরা নিশ্চই বলবেন, এখানে যে জাতি বাস করতো তারা ছিলো বিশ্বের সেরা শিক্ষিত! কারন তাদের দেয়ালে দেয়ালে বড় বড় হরফের দূর্বোধ্য লেখা পাওয়া গেছে। কী ফ্যান্টাসটিক! আমার ফেসবুক স্ট্যাটাসে এক মন্তব্যে এই গল্পটিও একাংশে আমি উলেখ করেছিলাম। আমার কল্পিত ‘বাজার’ আর ‘দেয়ালে’ লিখনের মধ্যে সাজুয্য রয়েছে।
যাক যা বলছিলাম। বলছিলাম ব্রাহ্মনবাড়িয়ার জানাজার কথা। এতো এতো লোকের ঠাসা ভিড়ে এই প্রচন্ড করোনা অতি দ্রæত যে ছড়িয়ে পড়বে না এই নিশ্চয়তা কি দেয়া যাবে? জানাজায় নেমেছিলো লক্ষ মানুষের ঢল। এর ফলাফল যে কতোটুকু গড়াতে পারে এই আশংকা কি কেউ করেননি? করোনা এমনি শক্তিশালী একটি ভাইরাস যার কারনে দ’ুচারজনও যদি সংক্রমিত থেকে থাকেন তাহলে তা নিশ্চই মূহুর্তে ছড়িয়েছে হাজারো মানুষের মধ্যে। এতোবড় দুস্কর্মটি সরকারের নাকের ডগায় ঘটে গেলো সরকার কিছুই করতে পারলো না। সরকার তাহলে কার কাঝে জিম্মি? জানাজা যদি নিয়ন্ত্রন করতে না পারেন তাহলে কোন নীতিতে সরকার বাজারে আসা মানুষ নিয়ন্ত্রন করবেন? আমরা জানি পবিত্র মক্কা মদীনায়ও কারফিউ দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে আসন্ন রমজানে তারাবীহ’র নামাজ ঘরে পড়ার আহŸান জানানো হয়েছে। আর কদিন পরেই রমজান মাসের শুরু। আগেভাগেই সবাইকে তারাবীহ’র মাধ্যমে যাতে সংক্রমন না হয় তার ব্যবস্থা করা দরকার। বাংলাদেশের মসজিদে রমজান মাসে লক্ষ লক্ষ মুসুলী খতম তারাবীহ’তে অংশগ্রহন করেন। পবিত্র রমজানে একটি বিশেষ সওয়াবের এই নামাজ সবাই পড়তে চাইবেন। কিন্তু বুঝতে হবে বাস্তবতা। মহানবী (স) কে বিশে^র সর্বশ্রেষ্ঠ জ্ঞানী হিসেবে অভিহিত করা হয়, কারন তার লব্দ জ্ঞান পুরোপুরি সর্বশক্তিমান আলাহ’র কাছ থেকে প্রাপ্ত। মহানবী নিজেই বলেছেন মহামারীর মতো দূর্যোগে কেউ যাতে নিজেদের স্থান ত্যাগ না করে। অর্থ্যাৎ যে যেখানে আছে সেখানেই যাতে অবস্থান করে।
পরিবেশ পরিচিতি বুঝতে হবে। মহানবী (স) র নির্দেশ না মেনে অন্যকে ধ্বংসের পথে ঠেলে দেয়া ইসলাম কি সমর্থন করে? তাছাড়া তারাবীহ’র নামাজ ঘরে পড়ায় তো কোন সমস্যা হবার কথা নয়। এমনিতেই আমাদের অবস্থা এখন খুবই করুন। অন্যান্য দেশ হয়তা একদিন সামলে উঠতে পারবে আমাদের কি সেই সঙ্গতি আছে? খাবার সংকটে লক্ষ মানুষ এখন মারাত্মকভাবে ধুকছে। সরকার এই ব্যাপারে তৎপর থাকলেও ত্রানডাকাতি এমন এক পর্যায়ে পৌঁছেছে তাও নিয়ন্ত্রনে রাখা কঠিন হয়ে পড়েছে। ত্রানডাকাতরা করোনাকে আশীর্বাদ হিসেবে নিয়ে তাদের অপকর্ম অব্যাহত রেখেছে। গোটা বিশ^ লাশ নিয়ে টানাটানি করছে আর আমরা ত্রান নিয়ে টানাটানি করছি। ত্রানডাকাতির এমন নোংরা পরিস্থিতিতে সরকারও বিব্রত। তাদের পাকড়াও করা হচ্ছে িিবিভন্ন স্থানে। তবু ঘটনা ঘটেই চলেছে।
তো সরকারী বিধি মেনে চললে বাজারে এভাবে অকারনে যাওয়াযাওয়ি না করলে আমাদের দেশে সংক্রমন বাড়তে পারতো না। বাজার বলতে আমি বুঝিয়েছি ঘরের বাইরের কথা। সাধারন মানুষের কথা বাদ দিলেও প্রচুর মানুষ কিন্তু অকারনে বাইরে বেরিয়েছে। পুলিশের প্যাঁদানী খেয়ে ঘরে গেলেও আবার তারা বেরিয়েছে। কুফা লাগিয়েছে প্রথমেই প্রবাসীরা। প্রবাসীদের আসার ব্যাপারে প্রথমেই নিয়ন্ত্রন করা হয়নি, পরীক্ষাও করা হয়নি। তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার সুষ্ঠু ব্যবস্থা নেয়া হয়নি। মুল কাজটা তাই করেছে এই প্রবাসীরাই। তারপর স্কুল কলেজ ছুটি দেবার পর সবার হাওয়া খাওয়া, গার্মেন্টস কর্মীদের মিছিল, নামাজ জানাজার সংক্রমন। এসব না হলে ভিয়েতনামের মতো আমাদের দেশে মৃত্যু থেকে যেতো শূন্যের কোঠায়। ভিয়েতনামে আড়াইশো মানুষ করোনায় আক্রান্ত হয়েছে। কিন্তু তাদের লকডাউন প্রথম থেকেই এমন কঠোরভাবে নিয়ন্ত্রন করা হয়েছিলো যে মাত্র একজন মহিলা আক্রান্ত হবার পর তারা প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে সক্ষম হয়েছিলো। সেই মহিলা এসেছিলো বিদেশ থেকে। পরীক্ষা করার সাথে সাথে মহিলা যাদের সংস্পর্শে এসেছিলেন জরুরী ভিত্তিতে সবাইকে ট্রেস করে বাধ্যতামূলক কোয়ারেনটাইনে নিয়ে তারা আসল কাজটি করে ফেলেছে। এখনো তারা বিশে^ প্রায় সকল দেশ থেকেই নিরাপদ। প্রাপ্ত এক পরিসংখ্যানে জানা যায় করোনা রোগীদের চিকিৎসায় সফল এবং কম মৃতুর হারের দিক দিয়ে বর্তমানে পৃথিবীতে সেরা ৩ দেশ। ১. সিঙ্গাপুর মোট আক্রান্ত ৮০২৫, মৃত ১১ জন, মৃতুর হার ০.১৪, রোগী সুস্থতার হার ৮০%, মৃতুবরণকারী ব্যাক্তিদের গড় বয়স ৮৪ বছর। ২. মালেশিয়ায় মোট আক্রান্ত ৫৪২৫ জন ,মৃত ৮৯ জন, মৃতুর হার ১.৬৪%, রোগী সুস্থতার হার ৬৪%, মৃতুবরণকারীদের গড় বয়স ৮২ বছর ৩. থাইল্যান্ড মোট আক্রান্ত ২৭৯২, মৃত ৪৭ জন, মৃতুর হার ১.৭০%, রোগী সুস্হতার হার ৭১%, মৃতুবরণকারীদের গড় বয়স ৮২ বছর। ( আরব আমিরাতে আক্রান্ত হয়েছে ৭২৬৫ জন,মৃত হয়েছে ৪৩ জন, মৃতুর হার ০.৬০%, সুস্থতার হার ১৯%, সুস্থ হয়েছে ১৩৬০ জন)। ভিয়েতনামে আক্রান্ত হয়েছে মাত্র ২৬৮ জন. মৃত ০ এখানে ১০০০ হাজারে উপরের আক্রান্ত সংখ্যা ধরা হয়েছে। কিউবাতে যখন ৩০০ জন আক্রান্ত ছিলো তখন তাদের মৃতুর সংখ্যা ০ ছিলো। এখন কিউবার আক্রান্তের সংখ্যা ১০৩৫ জন এবং মৃতুর সংখ্যা ৩৪ জন। মৃতুর হার ৩.৩% এবং সুস্থতার হার ২৫%. এখানে দেশগুলোর চিকিৎসা ব্যবস্থার সাফল্যতার কথা বলা হয়েছে।
আমাদের দেশেও প্রথম থেকে গুরুত্ব দিয়ে দেখা সম্ভব হলে ঠেকানো যেতো আজকের সমুহ বিপদ। এখন যা হবার হয়ে গেছে। পেছন ফিরে না তাকিয়ে যেখানে আমরা আছি সেখান থেকেই পথ চলতে হবে। এক্ষেত্রে সর্বাগ্রে প্রয়োজন সর্বমহলের ঐক্যমত্য। করোনা ঠেকানো শুধু সরকারের দায় নয়। এ দায় এখন দেশের সকলের। যদি এখনো তা বুঝতে কেউ ভুল করেন তাহলে এর খেসারত দিতে হবে সকলকে। যে খেসারতের নাম লক্ষ লক্ষ প্রাণহানি!
লেখক ঃ মীর লিয়াকত, সব্যসাচী লেখক।