শিক্ষাপঞ্জি লন্ডভন্ড
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ এপ্রিল ২০২০, ৪:১৫ অপরাহ্ণঅভিজিৎ ভট্টাচার্য্য::
করোনায় পড়াশোনার ক্ষতি পোষাতে ভরসা সংসদ টিভি ও অনলাইনে পাঠদান হলেও জনপ্রিয় নয়। করোনা ভাইরাসের সংক্রমণ ঠেকাতে প্রায় দেড় মাস ধরে দেশের সবধরণের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রয়েছে। আগামী ঈদ পর্যন্ত প্রাথমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ থাকবে। ৫ মে পর্যন্ত মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার কথা বলা হলেও সেটিও ফের বন্ধ দিয়ে ঈদ পর্যন্ত নেয়া হবে। সরকারি নির্দেশনার ওপরে নির্ভর করছে উচ্চ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের পথচলা।
বছরের তিন মাস যেতে না যেতেই হঠাৎ করে নেমে আসা এ বিপর্যয়ে চলতি বছরের পড়াশুনা অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়েছে। এরফলে প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রথম সাময়িক পরীক্ষা স্থগিত হয়েছে, জুন মাসে মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা হবে কি না তা নিয়েও অনিশ্চয়তা তৈরি হয়েছে। বছরের শেষে অনুষ্ঠিত জুনিয়র স্কুল সার্টিফিকেট পরীক্ষায়ও এর ধাক্কা লাগবে বলে জানা গেছে।
এছাড়া চলতি বছরের উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ১ এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল, কিন্তু করোনায় সেটি পিছিয়ে গেছে। কবে পরীক্ষাটি শুরু হবে তার সূচি এখনও ঠিক হয়নি। বলা হয়েছে, যেদিনই শিক্ষা প্রতিষ্ঠান খুলবে সেদিন থেকে পরবর্তী ১৫ দিনের মধ্যে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু হবে। তবে শিক্ষা প্রশাসন ৩১ মে অথবা মধ্য জুন থেকে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু করার মানসিক প্রস্তুতি নিচ্ছে। মে মাসের প্রথম সপ্তাহে চলতি বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশের কথা ছিল। করোনার থাবায় সেটিও নির্ধারিত সময়ে হচ্ছে না। এরফলে আগামী ১ জুলাই থেকে একাদশ শ্রেণির ক্লাস শুরু হওয়ার কথা, সেটির গতি কি হচ্ছে তাও এই মূহুর্ত্তে বলা যাচ্ছে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলোর তাদের সেমিষ্টার ভর্তি নিয়ে চিন্তিত। সরকারি বিশ^বিদ্যালয়ে এরইমধ্যে সেশনজটে পড়েছে। সবমিলিয়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনায় যে ধারাবাহিক রুটিন ছিল, তাতে বড়সড় ধাক্কা লেগেছে। তৈরি হয়েছে অনিশ্চয়তা। এই ধাক্কা কিভাবে সামাল দেয়া হবে তা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়েছে। সম্ভবত সিলেবাস সংক্ষিপ্ত করে চলতি বছরের পড়াশুনাটা চালিয়ে নেয়ার কথা ভাবছে সরকার।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, দীর্ঘ এই ক্ষতি পোষাতে এখন পর্যন্ত সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার আর কিছু প্রতিষ্ঠানে অনলাইনে পড়াশোনা ছাড়া ক্ষতি পোষানোর দৃশ্যমান কোনো উদ্যোগই নেই। সংসদ টেলিভিশনে ক্লাস প্রচার নিয়ে রয়েছে নানামত। বর্তমানে সংসদ টেলিভিশনে যেসব ক্লাস প্রচার হচ্ছে তাতে পিছিয়ে পড়া স্কুলের কিছু শিক্ষার্থী উপকৃত হলেও শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীদের কোনো লাভ হবে না। কারণ টেলিভিশেন যেসব ক্লাস প্রচার হচ্ছে শহর অঞ্চলের শিক্ষার্থীরা পড়ে ফেলেছেন। আর গ্রামাঞ্চলে এর প্রভাব খুব কমই পড়ছে।
গেল দশ বছর ধরে দেশে শিক্ষাপঞ্জি অনুযায়ী চলা শিক্ষাব্যবস্থা করোনা ভাইরাসের কারণে ‘লন্ডভন্ড’ হয়ে গেছে। এখন পর্যন্ত ঘোষণা অনুযায়ী সব স্তরের শিক্ষা প্রতিষ্ঠান আগামী ঈদের আগে চালু হচ্ছে না। শিক্ষাপঞ্জি অনুসারে রমজান, ঈদুল ফিতরসহ বেশকিছু ছুটি মিলিয়ে ২৫ এপ্রিল থেকে ৩০ মে পর্যন্ত এমনিতেই ছুটি থাকবে। এরআগে, করোনায় গত ১৭ মার্চ প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ হয়। সে হিসেবে লকডাউনে লন্ডভন্ড শিক্ষাপঞ্জি ফিরিয়ে আনাটাই সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ।
একাধিক শিক্ষার্থী-অভিভাবক বলছেন, সিলেবাস অনুযায়ী স্কুলে পড়ানো হয়। এরপর প্রত্যেক শিক্ষার্থীই একাধিক প্রাইভেট-কোচিংয়ের দ্বারস্থ হয়। তার পরও ঠিকমতো প্রস্তুতি হয় না। অথচ এবার স্কুল বন্ধ, প্রাইভেট-কোচিং বন্ধ। তার পরও পরীক্ষার প্রস্তুতি নিতে হচ্ছে। আর স্কুল খোলার পর কোনো রকমে তাড়াহুড়ো করে সিলেবাস শেষ করা হলেও শিক্ষার্থীরা তা আত্মস্থ করতে পারবে না। এজন্য মেঘ কেটে গিয়ে যখন আলো আসবে তখন যে পরীক্ষা হবে সেই পরীক্ষাগুলোতে অপেক্ষাকৃত সহজ প্রশ্ন প্রণয়নের দাবি অভিভাবকদের।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, প্রাথমিক থেকে মাধ্যমিক শিক্ষার শ্রেণি কার্যক্রম সংসদ টেলিভিশনে প্রচার হচ্ছে। এতে শিক্ষার্থীরা ঘরে বসে দেশের সেরা শিক্ষকদের ক্লাস করতে পারবে। প্রতিষ্ঠানে ক্লাস মিস হলেও পিছিয়ে পড়বে না শিক্ষার্থীরা। এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান দীর্ঘদিন বন্ধ থাকলেও ক্ষতির শিকার হবে না শিক্ষার্থীরা। প্রয়োজন হবে না কোচিং কিংবা নোট-গাইডের। টিভিতে ক্লাস দেখানোর পাশাপাশি অনলাইনেও ক্লাস হচ্ছে। এতে ক্ষতি পোষাতে সহায়ক হবে বলে মনে করছেন শিক্ষা পরিচালকরা। সরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোর সামান্য কটিতে অনলাইনে কিছু পাঠদান করানো হলেও ক্ষতি পোষাতে সহায়ক নয়। বহু বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় অনলাইনে ক্লাস নিয়ে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পুষিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে। কিন্তু সামার সেশনে ভর্তি নিয়ে তারা উদ্বিগ্ন। এতে ছোট ও নতুন বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলো পথচলা নিয়ে সন্দেহ রয়েছে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছেন, করোনার কারণে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ঠিক কদিনের ক্ষতি হচ্ছে তা চিহ্নিত করার পর ঠিকঠাক লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করে ক্ষতি পোষাতে বিরতিহীনভাবে কাজ চালানো হবে। তবে আপদকালীন ক্ষতি পোষাতে সংসদ টেলিভিশনে ষষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণির ক্লাস সম্প্রচার করা হচ্ছে। এতে সাময়িকভাবে শিক্ষার্থীরা উপকৃত হবে। তবে পুরো বিষয়রে ওপর আমাদের নজরদারি রয়েছে।
এরআগে করোনা ভাইরাস প্রতিরোধে দেশব্যাপী চলমান কার্যক্রম সমন্বয়ের লক্ষ্যে গণভবন থেকে একটি ভিডিও সম্মেলনের সময় শিক্ষার্থীদের উদ্দেশ্যে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছিলেন, ঘরে বসে সবাইকে পড়াশোনা করতে হবে। ছাত্রছাত্রীদের কাছে এটা আমার অনুরোধ। একটা সুযোগ এসেছে ভালোভাবে পড়াশোনা করার। পড়াশোনার মাধ্যমে নিজেকে এখন থেকে প্রস্তুত করো যখনই পরীক্ষা আসবে তখনই যেন পরীক্ষা দিতে পারো। একই সঙ্গে ক্লাস যেন ধরতে পারো সেজন্য পড়াশোনা করতে হবে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকার এসময় অনলাইন ও টেলিভিশনে ক্লাসের ব্যবস্থার কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ডিজিটাল পদ্ধতিতে স্কুলের ক্লাসগুলো আমরা করতে শুরু করেছি। ৬ষ্ঠ থেকে নবম শ্রেণি পর্যন্ত এই ক্লাসগুলো আমরা পর্যায়ক্রমিকভাবে করছি। ছেলেমেয়েরা ঘরে বসে থেকে লেখাপড়া যেন ভুলে না যায়।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, করোনাভাইরাসের কারণে প্রাথমিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ক্ষতি পুষিয়ে নিতে সংসদ টেলিভিশনে প্রচারের জন্য ভিডিও ক্লাস রেকর্ডিং করে প্রচার করা হচ্ছে। জানতে চাইলে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. আকরাম-আল-হোসেন বলেছেন, করোনাভাইরাসের কারণে আমরা যে সংকটে পড়েছি, তা থেকে শিক্ষা নিয়ে প্রাথমিক শিক্ষায় আমরা নতুন একটি দিগন্ত উন্মোচন করতে যাচ্ছি। অনেক সময় দেখা যায় শিশু শিক্ষার্থীরা ক্লাসে তাৎক্ষণিক পড়া বুঝতে পারছে না। ফলে তাদের কোচিং করাতে বাধ্য হন অভিভাবকরা। কিংবা নানা কারণে শিক্ষার্থীদের ক্লাস মিস হতে পারে। এসব বিষয় বিবেচনায় নিয়ে আমরা একটি নতুন অনলাইন পোর্টাল তৈরি করছি। সেখানে বিষয়ভিত্তিক শ্রেণি কার্যক্রমের ভিডিও থাকবে। যা থেকে শিক্ষার্থীরা সারা বছর প্রয়োজন মতো তার পাঠ বুঝে নিতে পারবে। শুধু করোনা পরিস্থিতির জন্য এই উদ্যোগ নেয়া হয়েছে তা নয়, সারা বছরই শিক্ষার্থীরা এই ব্যবস্থায় পাঠ নিতে পারবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদফতরের মহাপরিচালক মো. ফসিউল্লাহ্ বলেছেন, শিক্ষার্থীরা অনলাইনে তার প্রয়োজনীয় ক্লাস বারবার দেখে তার বিষয়ভিত্তিক পাঠ আয়ত্ত করতে পারবে। ধারাবাহিকভাবে আমাদের এই কাজ চলবে।
আগামী মে মাসের প্রথম সপ্তাহে মাধ্যমিক ও সমমানের ফল প্রকাশের কথা। কিন্তু বর্তমান পরিস্থিতিতে ওএমআর শিট দেখা স্থগিত করেছে শিক্ষা বোর্ডগুলো। এ ছাড়া সব কিছু বন্ধ থাকায় লিখিত পরীক্ষার খাতা মূল্যায়নের পর তা বোর্ডে ফেরত দিতে পারছেন না পরীক্ষকরা। এরফলে ৬০ দিনের মধ্যে ফল প্রকাশ নিয়েও অনিশ্চয়তা রয়েছে।
জানতে চাইলে আন্তঃশিক্ষাবোর্ডের সভাপতি ও ঢাকা শিক্ষা বোর্ডের চেয়ারম্যান অধ্যাপক মু. জিয়াউল হক বলেছেন, উত্তরপত্র মূল্যায়নের কাজ শেষ হয়েছে। কিন্তু স্ক্যানিংয়ের কাজ শেষ হয়নি। আমরা চেষ্টা করছি মে মাসের মধ্যেই অন্তত মাধ্যমিকের ফল প্রকাশ করতে পারা। আর করোনা পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অন্তত ১৫ দিন পর থেকে উচ্চ মাধ্যমিক ও সমমানের পরীক্ষা শুরু করতে পারব। সেক্ষেত্রে উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষা ঈদের পরে শুরু হতে পারে বলে তিনি জানান।
করোনার প্রাদুর্ভাবে গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে সব বিশ্ববিদ্যালয়। বন্ধ রয়েছে পরীক্ষাও। এমনকি বছরজুড়েই থাকে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের নানা পরীক্ষা। কিন্তু করোনার কারণে সব পরীক্ষা অনির্দিষ্টকালের জন্য স্থগিত করা হয়েছে। জুলাই মাসে উচ্চ মাধ্যমিকের ফল প্রকাশের পর বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় ভর্তি প্রক্রিয়া শুরু হয়। নভেম্বরে ক্লাস শুরু হয়। কিন্তু এবার যথাসময়ে ভর্তি প্রক্রিয়া ও ক্লাস শুরু করা সম্ভব হবে না। বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালগুলোয় গ্রীষ্মকালীন সেমিস্টারের ভর্তি প্রক্রিয়া আটকে গেছে।
জানতে চাইলে বাংলাদেশ বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় সমিতির চেয়ারম্যান শেখ কবীর হোসেন বলেছেন, কিছু বিশ^বদ্যালয় ক্ষতি পোষাতে অনলাইনে পাঠদান কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু নতুন ও ছোট বিশ^বিদ্যালয়গুলো কিছুই করতে পারছে না। এতে তাদের বিশাল ক্ষতি হচ্ছে। অন্য এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, বড় কয়েকটি বিশ^বিদ্যালয় অনলাইনে গ্রীষ্মকালীন সেশনে শিক্ষার্থী ভর্তি করাচ্ছে। কিন্তু বেশিরভাগ বেশিরভাগ বিশ^বিদ্যালয় তা করতে পারছে না। এতে তাদের ক্ষতি হচ্ছে বেশি।