চা শিল্পের ইতিবৃত্ত : পরিপ্রেক্ষিত সিলেট
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৮ এপ্রিল ২০২০, ৪:২৬ অপরাহ্ণমুহম্মদ সায়েদুর রহমান তালুকদার::
চা বাগান প্রতিষ্ঠার ইতিহাস : চা একটি চীনা ভাষার শব্দ। সর্ব প্রথম চা পানের প্রচলন শুরু হয় চীন দেশে। অনুমান করা হয়, খ্রিস্ট জন্মের প্রায় ৩৫০০ বছর পূর্বে চীনে চা গাছের সন্ধান পাওয়া গিয়েছিল। বি সি এলেন সম্পাদিত আসাম ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ারস-এর তথ্যানুযায়ী ১৮২৩ খ্রিস্টাব্দে ভারতের আসামাঞ্চলে প্রথম বন্য চা আবিস্কৃত হয়। এতে আসামের ভূমি যে চা চাষের উপযোগী সে ধারণা জন্মে। এর ভিত্তিতে ১৮৩৫ সালে লখিনপুরে পরীক্ষামূলক ভাবে প্রথম একটি চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, সিলেটে চা চাষের সম্ভাব্যতা যাচাইয়ের পর ১৮৪৭ সাল প্রথমে মালনীছড়া ও পরে হবিগঞ্জের লালচান্দ চা বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। তবে চা বোর্ডের রেকর্ড অনুযায়ী দেখা যায়, ১৮৩৭ সালে শমসেরনগর ও করিমপুর, চা বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। তৎকালীন সিলেট জেলায় চা চাষের সন্তুষজনক লক্ষমাত্রা অর্জিত হওয়ায় বহু উদ্যোক্তা তাতে আগ্রহ প্রকাশ করে। কিন্তু তখন এ কাজে যে কঠোর পরিশ্রমী অথচ সস্তা শ্রমিকের প্রয়োজন তার যোগান স্থানীয়ভাবে সম্ভব ছিল না। তাই ইংরেজরা বাধ্য হয়ে ভারতবর্ষের বিভিন্ন স্থানে সস্তার শ্রমিক খুঁজতে থাকে। এ পর্যায়ে ভারতের ছোট নাগপুর, মাদ্রাজ, বিহার, উড়িষ্যা, অন্ধ্র প্রদেশ, উত্তর প্রদেশ, মধ্য প্রদেশ, পশ্চিম বঙ্গ প্রভৃতি অঞ্চলের দরিদ্র চাষী ও দুর্ভিক্ষপীড়িত সাওতাল, মুÐা, কুলবালি, লোহার, কুর্মী, ভূমিজ প্রভৃতি আদিবাসী গোষ্টীদেরকে দালালের মাধ্যমে নানা প্রলোভনে ভুলিয়ে ক্ষেত্র বিশেষে জোর করে এ দেশে নিয়ে আসা হয়।
দূর দূরান্তের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে বিশেষ ব্যবস্থায় আগত এই সকল সহজ-সরল লোকদেরকে সামান্য মজুরির বিনিময়েই যন্ত্রের মতো কাজ করতে হতো। প্রথম থেকেই এ সকল শ্রমিককে কঠোর নজরদারীর মধ্যে রাখা হয়েছিল। পাহাড়ে জনবিচ্ছিন্ন অবস্থায় অস্থায়ী কলোনির মধ্যে তারা কঠোর নিরাপত্তা বেষ্টনীতে জীবন যাপন করতে বাধ্য ছিল। তাদের সুখ-দুঃখ, ইচ্ছা-অনিচ্ছা, চাওয়া-পাওয়া প্রভৃতি হিসাব মিলানোর সুযোগ ছিল না। সীমিত মজুরি আর সামান্য রেশনের বিনিময়ে সকাল-সন্ধা তাদেরকে কর্মব্যস্ত রাখা হতো। প্রতিটি বাগানে ‘পাট্টা’ বা নি¤œ মানের মদের দোকান খোলে এর মাধ্যমে মদ সরবরাহ করে তাদের অবসর, বোধ ও বুদ্ধি কেড়ে নেয়ার দুরভিসন্ধি করা হয়। ফলে নানা ভাষা, ধর্ম, বর্ণ, সংস্কৃতি, জাত, উপজাত সব একাকার করে বাগান এলাকায় সৃষ্টি হয়েছে একটি মিশ্র সংস্কৃতির নব্য সম্প্রদায়। স্থানীয়দের সাথেও এদের ভাষা, ধর্ম ও সংস্কৃতিগত কোনোই সম্পর্ক নেই। সমষ্টিগত দিক থেকে আজ এরা এককভাবে না কোনো স্বতন্ত্র জাতি, না কোনো উপজাতি, না কোনো ধর্ম বা বর্ণের ধারক বা বাহক।
প্রথম থেকেই চা বাগান প্রতিষ্ঠায় উৎসাহ প্রদানের জন্য নাম মাত্র খাজনায় জমি বরাদ্দ দেয়া হতো। এ সুবিধা গ্রহণ করে দক্ষিণ সিলেট (মৌলভীবাজার) মহকুমায় ১০২ জন, হবিগঞ্জ মহকুমায় ২৬ জন এবং উত্তর সিলেটে (সিলেট সদর) মহকুমায় ১৫ জন ইউরোপিয়ান চা-কর বাগান করেছিলেন বলে জানা যায়। ১৯৯২ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত সারা দেশে ১৫৮টি চা বাগানের আওতায় ১,১২,৩০১.১৪ হেক্টর জমি ছিল। তন্মধ্যে সিলেট বিভাগে ১৩৪টি চা বাগানের আওতায় ৯৮,৯৮২.১১ হেক্টর জমি রয়েছে। বাকী ২৪টি বাগানের অধীন ১৩,৩১৯.০৩ হেক্টর জমি চট্টগ্রাম, পার্বত্য চট্টগাম ও ব্রাহ্মণবাড়ীয়ায় বিদ্যমান। ১৯৬৫ খ্রিস্টাব্দে এখানকার ৫৬টি বাগানের মালিক ছিলেন পাকিস্তানী, ৪৭টি বাগানের মালিক ছিলেন ইউরোপীয় এবং ১১টি বাগানের মালিক ছিলেন ভারতীয়। বর্তমানে বিদেশী মোট ১২টি কোম্পানির মালিকানায় ২৬টি, বাংলাদেশী ৩৫টি কোম্পানির মালিকানায় ৫৪টি এবং ব্যক্তি মালিকানায় ৫২টি বাগান রয়েছে।
চা বাগানের ব্যবস্থাপনা : চা শিল্পের ব্যবস্থাপনার ধারাবাহিক বিশ্লেষণে দেখা যায়, ভারতের গভর্নর জেনারেল উইলিয়াম ব্যান্টিংক ১৮৩৪ সালে সর্বপ্রথম চা চাষাবাদ, উৎপাদন ও বিপণনের লক্ষে ‘টি কমিটি’ গঠন করেন। পরবর্তীতে বেসরকারি পর্যায়ে ‘আসাম টি কোম্পানি’ এবং ১৮৮১ সালে ‘ইন্ডিয়ান টি এসোসিয়েশন’ গঠিত হয়। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর চা শিল্পের উন্নয়নের লক্ষ্যে চাষাবাদ, বাজারজাতকরণ ও রপ্তানি নিয়ন্ত্রণ প্রভৃতি বিষয় তদারক করার জন্য ‘পাকিস্তান টি এ্যাক্ট’ এর আওতায় ১৯৫০ সালে ‘পাকিস্তান টি বোর্ড’ গঠিত হয়। ১৯৭৭ সালে ‘পাকিস্তান টি বোর্ড’ এর নাম পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ চা বোর্ড’ করা হয়। ১১ সদস্য বিশিষ্ট এই বোর্ড চা শিল্পের সার্বিক ব্যবস্থাপনার কাজ চালিয়ে যায়। বোর্ডের অধীন ‘বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট’ ও ‘প্রকল্প উন্নয়ন ইউনিট’ নামে দুটি অঙ্গ প্রতিষ্ঠান রয়েছে। এ দুটি প্রতিষ্ঠানই শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত।
চায়ের রাজ্যে পর্যটন :
প্রাকৃতি সৌন্দর্যের লীলানিকেতন চায়ের রাজ্য সিলেট। এ রাজ্য গড়ে উঠেছে কোটি কোটি বছর পূর্বেকার টারশিয়ারি যুগের ভূ-শ্রেণিতে। হিমালয় পর্বতের সাথে সংযুক্ত আসাম পাহাড় শ্রেণির অংশ বৃহত্তর সিলেটের পূর্ব পার্শ্বস্থ পাহাড়াঞ্চল। প্রকৃতির অকৃপণ দান এ পাহাড়-বনের সম্পদ ও নিসর্গশোভায় গর্বিত সিলেট। পাহাড়ের পরতে পরতে চিরহরিৎ বৃক্ষ-তরু, লতাগুল্মের শ্যামলিমায় জীববৈচিত্রের নানা ছন্দে মানুষের মনে জাগায় অনাবিল আনন্দ। এই মনোরম নিসর্গধামে সাজানো গাছগাছালীর অপূর্ব সমাহার। পাহাড় ভরা বন-বনানী আর সবুজ গালিচার ন্যায় বিস্তৃত চা গাছের অপরূপ শোভায় শোভিত হচ্ছে সিলেট, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ জেলার বিশাল অঞ্চল। ঢেউ খেলানো পাহাড়ি টিলায় সাজানো দুটি পাতা একটি কুড়ি’র সাথে সারি সারি চা কন্যাদের পাতা তোলার দৃশ্য, নির্ধারিত দূরত্বে সাজানো আকাশচুম্বী ছায়াতরুর মায়া, বনানীঘেরা আঁকা-বাকা পথের মোহমায়া সৌন্দর্য পিয়াসী মানুষের মনে জাগায় সীমাহীন ভাব-বিহŸলতা।
প্রতিটি চা বাগানেই রয়েছে এক একটি কোম্পানি বাংলো। যেখান থেকে সেখানকার প্রকৃতিকে খুব কাছে থেকে উপভোগ করা যায়। বাগানের পায়ে হাটা সেকশনগুলোর যোগাযোগ রাস্তায় মাটির সুধাগন্ধের পাশাপাশি চা পাতার মাতাল করা সুবাস আর দৃষ্টিনন্দন রূপমাধুর্যে বিমোহিত হয় মন-প্রাণ। চা বাগানের এই নয়নাভিরাম প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের পাশাপাশি অত্রাঞ্চলে রয়েছে নানা প্রজাতির উদ্ভিদ ও বন্যপ্রাণী সমৃদ্ধ লাউয়াছড়া, সাতছড়ি, রেমা-কালেঙ্গা জাতীয় উদ্যান। বিশাল বিশাল রাবার বাগান, আনারস বাগান, লেবু বাগান প্রভৃতির চিত্তাকর্ষক দৃশ্য; মণিপুরী ও খাসিয়া সম্প্রদায়ের জীবনচিত্র ও সংস্কৃতির লালনক্ষেত্র এ অঞ্চলকে করেছে আরো আকর্ষণীয়। মুক্তিযুদ্ধের আনুষ্ঠানিক সূচনাকেন্দ্র ও মুক্তিবাহিনীর প্রথম সদর দপ্তর তেলিয়াপাড়া চা বাগানের স্মৃতিসৌধ, মাধবকুÐ জলপ্রপাত, জাফলংয়ের পাথুরে রাজ্য, মাধবপুর লেক, মাগুরছড়া পরিত্যাক্ত গ্যাসকূপ, আলিয়াছড়া পানপুঞ্জিতে চা কন্যার ভাষ্কর্য, ফয়েজাবাদ বধ্যভূমি প্রভৃতি অসংখ্য দর্শণীয় স্থান এখানকার প্রকৃতিকে করেছে অলঙ্কৃত।
সবুজ শ্যামলিমায় ঘেরা শ্রীমঙ্গলে অবস্থিত বাংলাদেশ চা গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিটিআরআই)। বাংলাদেশ চা বোর্ড ২০০৬ সন থেকে শ্রীমঙ্গলের ভাড়াউড়া চা বাগানে নির্মিত বিটিআরআই-এর বিদেশী পরামর্শকদের আবাসন কমপ্লেক্সটি ‘টি রিসোর্ট’ হিসেবে বাণিজ্যিক ভিত্তিতে পরিচালনা করছে। দেশীয় অভিজাত, সামর্থবান ব্যক্তিরা অবকাশ যাপনের জন্য এখানে আসেন। বিভিন্ন উন্নয়ন প্রকল্পের পরামর্শক হিসেবে এ দেশে কাজ করতে আসা বিদেশীরাও বিনোদনের জন্য এখানে আসেন। কনফারেন্স হল, জিমনের্শিয়াম, চিড়িয়াখানাসহ নানা রকম বিনোদন সুবিধা এখানে বিদ্যমান।
টি রিসোর্টে ২০০৯ সালে একটি মিউজিয়াম প্রতিষ্ঠা করা হয়। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান পাকিস্তান আমলে টি বোর্ডের চেয়ারম্যান থাকাকালে শ্রীমঙ্গলের নন্দরানী চা বাগান পরিদর্শনে গিয়ে যে চেয়ার-টেবিল ব্যবহার করেছিলেন সেগুলো এখানে সংরক্ষণ করা হয়েছে। পাকিস্তানের সাবেক প্রেসিডেন্ট আইয়ুব খানের ব্যবহৃত গাড়ির চেচিস, ব্রিটিশ আমলে বাগান এলাকায় ব্যবহৃত বিশেষ কয়েন, কম্পাস, ঘড়ি, পাম্প টিউবওয়েল, চা গাছের মোড়া ও টেবিল, পাথর হয়ে যাওয়া গাছের খÐ, কোরোসিন চালিত ফ্রিজসহ ব্যবহার্য বিভিন্ন জিনিষপত্র মিউজিয়ামের প্রদর্শন সামগ্রী হিসেবে শোভা পাচ্ছে।