করোনা সংকট : বেকার হবে দেড় কোটি মানুষ, জিডিপি নেমে আসার আশঙ্কা দুই-তিন শতাংশে

পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মে ২০২০, ৫:০১ অপরাহ্ণঝর্ণা মনি ::
করোনাভাইরাস কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ্বের কর্মক্ষম মানুষের ৮১ শতাংশ অর্থাৎ ৩৩০ কোটি মানুষ আংশিক অথবা পুরোপুরি বেকার হয়ে যাওয়ার আশঙ্কা করছে জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক শ্রম সংস্থা (আইএলও)। এই প্রভাব সবচেয়ে মারাত্মক আকার ধারণ করবে বাংলাদেশের মতো জনবহুল দেশগুলোতে। আর বাংলাদেশের বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান পলিসি রিসার্চ ইনস্টিটিউটের সা¤প্রতিক তথ্যমতে, করোনার কারণে বাংলাদেশে চাকরি হারাবে অন্তত দেড় কোটি মানুষ। ওই জরিপ অনুযায়ী, প্রতি পরিবারে গড়ে ৪ জন করে সদস্য ধরা হলে অনিশ্চয়তার মধ্যে পড়বে অন্তত ৫ কোটি মানুষ। গত এপ্রিলের প্রকাশিত আইএলও’র নতুন প্রতিবেদন বলছে, ভাইরাসের প্রভাবে বিশ্ব অর্থনৈতিক মন্দায় সবচেয়ে ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে তরুণরা। বিগত ২০ বছরের তুলনায় গত বছর বৈশ্বিকভাবে তরুণদের মধ্যে বেকারত্বের হার বেড়ে রেকর্ড ১৩ দশমিক ৬ শতাংশ হয়েছে। ভাইরাস মোকাবিলায় বিশ্ব ব্যর্থ হলে তরুণরা আরো বেকার হয়ে পড়বে। বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) হিসাবে, দেশে দরিদ্র মানুষের সংখ্যা ৩ কোটি ৪০ লাখ। এরমধ্যে হতদরিদ্র মানুষ পৌনে দুই কোটি। শ্রমিকের সংখ্যা ৬ কোটি ৪০ লাখের মতো। এরমধ্যে ২ কোটি ৪০ লাখ কাজ করেন কৃষিখাতে। বাকি প্রায় ৪ কোটি কাজ করছেন শিল্প ও সেবা খাতে। এরমধ্যে অধিকাংশ কাজ করছেন অনানুষ্ঠানিক খাতে। এদিকে ১২ এপ্রিল পাওয়ার অ্যান্ড পার্টিসিপেশন রিসার্চ সেন্টার (পিপিআরসি) ও ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভর্ন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (বিআইজিডি) বাংলাদেশের শহর ও গ্রামের ৬ হাজার করে মোট ১২ হাজার নিম্ন আয়ের পরিবারের ওপর টেলিফোনের মাধ্যমে এক যৌথ গবেষণা করে। প্রতিবেদন অনুযায়ী, করোনাভাইরাসের কারণে অর্থনৈতিক সংকটে সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়বে নিম্ন আয়ের মানুষ। সারাদেশেই বাড়তে থাকবে দারিদ্র্যের প্রবণতা। শহরের রিকশাচালক, দিনমজুর, গৃহপরিচারিকা, রেস্টুরেন্টকর্মী, ভাসমান ব্যবসায়ী, অটোচালক, গ্রামের কৃষক, জেলে, দোকানি, বিদেশফেরত মানুষেরা সবচেয়ে বড় বিপদে পড়বেন। জানতে চাইলে বাংলাদেশ উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠানের অর্থনীতিবিদ ড. নাজনীন আহমেদ পূবের হাওয়াকে জানান, প্রতিবছরই দেশে সাড়ে ৩ শতাংশ করে বেকার বাড়ছে। প্রতিবছর দেখা যায় ৫ লাখ মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। গণনা পদ্ধতির কারণে কম আসে। তবে বাস্তবে এরচেয়ে বেশি। অনানুষ্ঠানিক খাতে বেকারত্বের সংখ্যা অনেক সময় গণনায় আসে না। করোনার কারণে গত একমাস অর্থনৈতিক কর্মকাণ্ড বন্ধ থাকায় সেবা খাত ও শিল্পখাত মারাত্মক ক্ষতির মুখে পড়েছে। অনেকেই বেকার হয়ে পড়েছেন। এই সংখ্যা দিন দিন আরো বাড়বে। কারণ কোনো প্রতিষ্ঠানই অনির্দিষ্টকালের জন্য শ্রমিক-কর্মচারীদের বসিয়ে বসিয়ে বেতন দেবে না। তিনি বলেন, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি কমে যাবে। কারণ যোগান ও চাহিদা দুটোই কমবে। অর্থনীতির গতিধারা সুখকর নয়। চাকা স্বাভাবিকভাবে ঘুরছে না। শুধু বাংলাদেশ নয়, আন্তর্জাতিকভাবেই জিডিপি কমে যাচ্ছে। অর্থনীতির চাকা ঘুরে দাঁড়ালে এবং কার্যকর নীতি-কৌশল অবলম্বন করা গেলে পরিস্থিতি মোকাবিলা সম্ভব হবে।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর হিসেব অনুযায়ী, দেশের অর্থনীতিতে এখন সেবা খাতের অবদান প্রায় ৫০ শতাংশ। এছাড়া শিল্পখাত ৩৫ শতাংশ এবং কৃষির অবদান এখন ১৪ শতাংশের মতো। দেশের অর্থনীতির প্রতিটি খাতই এখন মারাত্মক হুমকির মুখে। এদিকে বাংলাদেশ গার্মেন্টস অ্যান্ড ইন্ডাস্ট্রিয়াল শ্রমিক ফেডারেশন (বিজিআইডব্লিউএফ), বাংলাদেশ মুক্ত গার্মেন্ট শ্রমিক ইউনিয়ন ফেডারেশন (বিআইজিইউএফ) এবং বাংলাদেশ সেন্টার ফর ওয়ার্কার্স সলিডারিটি (বিসিডব্লিউএস) বলছে, লকডাউনের মধ্যেই প্রায় ১০ হাজার পোশাকশ্রমিক ছাঁটাইয়ের শিকার হয়েছেন। সংগঠন তিনটির পক্ষ থেকে পাঠানো সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে বলা হয়েছে, করোনাভাইরাসের এই মহামারির সময়ে মালিকরা ঢাকা, আশুলিয়া, সাভার, গাজীপুর, নারায়ণগঞ্জ ও চট্টগ্রামের বিভিন্ন পোশাক কারখানা প্রায় ১০ হাজার শ্রমিক ছাঁটাই বা কর্মচ্যুত করেছে। এ ব্যাপারে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম পূবের হাওয়া কে বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে মানুষের জীবন বিপর্যস্ত। কিন্তু শোষক-লুটেরা শিল্প মালিকরা এমন দুর্যোগেও শ্রমিকদের মানুষ হিসেবে গণ্য করছে না। কাজ থেকে রেহাই দিচ্ছে না। বরং মুনাফা লাভের হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে। একবার বলছে, কলকারখানা বন্ধ, বাড়ি যাও। আবার লকডাউনের মধ্যেও চাকরি খেয়ে ফেলার হুমকি দিয়ে অত্যন্ত অমানবিকভাবে গ্রাম থেকে শহরে আনিয়েছে। সবই নিজেদের স্বার্থে করছে। যে শ্রমিক শ্রমে-ঘামে কলকারখানার চাকা সচল রেখেছে, তার মুনাফা তো সবই লুটেরাদের পকেটে যায়। এই দু:সময়ে তাদের পাশে না দাঁড়িয়ে বরং বেকারত্বের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। একজন শ্রমদাস মরলে শিল্পমালিকের বরং সুবিধা বেশি। অল্প টাকায় আরেকজন শ্রমদাস কিনতে পারে। কিন্তু এটুকু ভাবছে না করোনা সংকটে শ্রমদাসরা ধ্বংস হলে তারা নিজেরাও ধ্বংস হয়ে যাবে।
বাংলাদেশের অর্থনীতি সম্পর্কে বিশ্বব্যাংক বলছে, এখন একই মেয়াদে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ৮ শতাংশ থেকে নেমে হবে দুই থেকে তিন শতাংশ। ২০২১ সালে অবস্থা আরো খারাপ হবে। আর আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলও (আইএমএফ) বলছে, ২০২০ সালে বাংলাদেশের জিডিপি প্রবৃদ্ধি ২ শতাংশ হতে পারে। ৭ এপ্রিল পর্যন্ত প্রাপ্ত তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে দেয়া আইএমএফের ‘ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক আউটলুক ২০২০, দ্য গ্রেট লকডাউন’ প্রতিবেদনে এই পূর্বাভাস দেয়া হয়েছে।
এই পরিস্থিতিতে যে ক্ষতি হচ্ছে তা জাতীয় ক্ষতি এবং সবাইকে এটা ভাগ করে নিতে হবে মন্তব্য করে বাংলাদেশের ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি রাশেদ খান মেনন বলেন, পুঁজির ধর্ম মুনাফা খোঁজা এবং এজন্য পুঁজির মালিক নিজের গলায় ফাঁস দিতেও দ্বিধা করে না। তাদের এই মুনাফা লোভের জন্য জনগণকে জিম্মি করা কেন? শ্রমিকদের নিশ্চিত আক্রান্ত হওয়া ও মৃত্যুর মুখে ঠেলে দেয়া কেন? তিনি বলেন, গার্মেন্টস শিল্পসহ শিল্প-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান এভাবে খুলে দেয়া কেবল অবিবেচনা প্রসূতই নয়, জনগণের জীবনকে জিম্মি করার শামিল। করোনা পরিস্থিতি সামাল দেয়া হলে এদেশের কৃষক-শ্রমিক-শ্রমজীবী মানুষ তাদের পরিশ্রম দিয়ে অর্থনীতির চাকাকে আবার উর্ধমুখী করবে এটি আমার বিশ্বাস।