শিক্ষাক্রমে অনিশ্চয়তা : অনলাইনই ভরসা
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ মে ২০২০, ৫:০৬ অপরাহ্ণঅভিজিৎ ভট্টাচার্য্য::
করোনার সংক্রমণ ঠেকাতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রয়েছে। ধাপে ধাপে বন্ধের দিন আরো বাড়ছে। পরিস্থিতি সামাল দিতে বহু স্কুল, কলেজ ও বিশ^বিদ্যালয়ে শুরু হয়েছে অনলাইন ক্লাস। টেলিভিশনেও ক্লাস স¤প্রচার হচ্ছে। বাড়ি থেকে ক্লাসে অংশ নিচ্ছে শিক্ষার্থীরা। শিক্ষকেরাও বাড়িতে বসেই পড়াচ্ছেন। এ অবস্থায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা স¤প্রতি এক ভিডিও সম্মেলনে বলেছেন, পরিস্থিতি যদি উন্নতি না ঘটে তাহলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে।মূলত প্রধানমন্ত্রীর এই বক্তব্য আসার পরই শিক্ষা প্রশাসন, অভিভাবক, শিক্ষক ও শিক্ষার্থীরা বিষয়টিকে নিয়ে নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। অনেকেরই ভাবনা ছিল, ঈদের ছুটির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোকে খুলে দেয়া হবে। এরই আলোকে দীর্ঘ ছুটির পর শিক্ষা প্রতিষ্ঠান চালু হলে কিভাবে ক্ষতি পুষিয়ে নেয়া হবে তারও একটি পরিকল্পনা প্রণয়ন করে রেখেছিল শিক্ষা প্রশাসন। কিন্তু প্রধানমন্ত্রীর কথার পর নতুন করে ভাবনা শুরু করেছেন সংশ্লিষ্টরা। তবু তারা বলেছেন, এক্ষেত্রে শিক্ষায় অনলাইনই এখন একমাত্র ভরসা। এতে হয়ত পরীক্ষা নেয়া যাবে না। কিন্তু পাঠদান এগিয়ে রাখা যাবে। শিক্ষার্থীরা পড়শোনার মধ্যে থাকবে।
তবে অনলাইনে পাঠদানের ক্ষেত্রে বৈষম্য তৈরি হয় বলে মন্তব্য করেছেন জগন্নাথ বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মীজানুর রহমান। তার মতে, পড়াশুনার চেয়ে জীবন বড়। ভ্যাকসিন বের হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রাখতে হবে। এরকম পরিস্থিতিতে অনলাইনে লেখাপড়ার কথা বলা হচ্ছে। কিন্তু সবাই কি অনলাইনে পাঠদান নিতে পারছে। সবার কাছে তো ইন্টারনেট সুবিধা নেই। এতেতো নতুন করে বৈষম্য তৈরি হচ্ছে। তিনি বলেন, এটা করো, ওটা করো বলে চালিয়ে নেয়া যায়। কিন্তু ক্লাসরুমের কোনো বিকল্প নেই। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হওয়ার অপেক্ষা ছাড়া কোনো বিকল্প নেই বলে জানান তিনি।
এদিকে, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের উচ্চ শিক্ষার গতিপথ কি হবে সে নিয়ে গত ৩০ এপ্রিল শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপুমনি বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) সঙ্গে অনলাইনে বৈঠক করেছেন। বৈঠক শেষে বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের (ইউজিসি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুলাহ বলেছিলেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে দেশের উচ্চ শিক্ষা কীভাবে চলবে তার একটি রোডম্যাপ জারি করা হবে। ২ মে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, চলতি সপ্তাহেই সেই রোডম্যাপ জারি হতে পারে।
প্রসঙ্গত, ভারতের বিশ^বিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশন বুধবার এক আদেশ জারি করে বলেছে, স্নাতক প্রথম ও দ্বিতীয় বর্ষের শিক্ষার্থীদের কোনো পরীক্ষা দেয়ার প্রয়োজন হতে পারে না। শুধু তৃতীয় ও চতুর্থ বর্ষের পরীক্ষার্থীরা পরীক্ষা নেবে। এই পরীক্ষা কিভাবে নেয়া হবে তা দেশটির বিশ^বিদ্যালয়ের ওপর ছেড়ে দেয়া হয়েছে। এছাড়া কোভিড-১৯ এর কারণে বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে সেশনজটও লাগতে পারে।
বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষায়ও কি ভারতের মতো পদক্ষেপ নেয়া হচ্ছে কি নাÑজানতে চাইলে ইউজিসি চেয়ারম্যান অধ্যাপক ড. কাজী শহীদুলাহ বলেন, তারা (ভারত) তাদের হিসাব অনুযায়ী নির্দেশিকা জারি করেছে। আমরাও আমাদের মত করে একটি নির্দেশিকা জারি করব। তিনি বলেন, আমাদের দেশের পাবলিক বিশ^বিদ্যালয়গুলোতে সেশনজট কিভাবে কাটাতে হয় তার কৌশল জানা আছে এবং পরিস্থিতি উন্নতি ঘটলে ছুটির দিনগুলোতে ক্লাস-পরীক্ষা নিয়ে সেই সেশনজট কাটিয়ে দেয়া যাবে। মুশকিল হচ্ছে বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয়গুলোকে নিয়ে। ওদেরকে আমরা বলেছিলাম অনলাইনে ক্লাস নেয়ার জন্য। তারা আরো একধাপ এগিয়ে অনলাইনেই পরীক্ষা নেয়াসহ ভর্তিও কার্যক্রম শুরু করে দিয়েছিল। এর কিছু খারাপ দিকও রয়েছে। তবুও আমরা বলেছি, অনলাইনে ক্লাস করানোর পাশাপাশি পরীক্ষা কিংবা ভর্তি কার্যক্রম করতে পারবে।
অন্যদিকে, অভিভাবকরা প্রশ্ন তুলে বলেছেন, চলতি বছরের মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ কবে হবে? এ পরীক্ষার ফলাফল প্রকাশ করতে না পারলে একাদশ শ্রেণির ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ হবে না। আর ভর্তি প্রক্রিয়া শেষ না হলে পয়লা জুলাই থেকে একাদশ শ্রেণির ক্লাসও শুরু করা যাবে না। একইসঙ্গে চলতি বছরের উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার কী হবে? পরীক্ষাটি গত পয়লা এপ্রিল থেকে শুরু হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু এখন কি পরীক্ষাটি সেপ্টেম্বরে চলে যাবে? উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা যদি সেপ্টেম্বরেই হয় তাহলে বিশ^বিদ্যালয় ভর্তি পরীক্ষা কি ডিসেম্বরে চলে যাবে? সবমিলিয়ে চলতি বছরের শিক্ষাপঞ্জিকেই কিভাবে বাস্তবায়ন করা হবেÑএনিয়ে চরম অনিশ্চয়তা দেখা দিয়েছে।
শিক্ষা প্রশাসনের সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, নি¤œমাধ্যমিক ও মাধ্যমিকশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে আগামী জুন মাসে অনুষ্ঠিতব্য অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। আর দীর্ঘসময় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় অনলাইন কিংবা টেলিভিশনেই ক্লাস এখন শিক্ষায় চলার পথের একমাত্র ভরসা। কিন্তু সেখানেও বাধা রয়েছে। অনলাইনে পাঠদান জনপ্রিয় হচ্ছে না। বহু শিক্ষার্থীর কাছে ইন্টারনেটের সংযোগ নেই। আবার ইন্টারনেট সংযোগ থাকলেও কেনার সামর্থ্য নেই। একইসঙ্গে তাদের কাছে একটি ল্যাপটপ, ডেস্কটপ বা স্মার্টফোন নেই। ফলে চাইলেই অনলাইন শিক্ষা সর্বজনীন করা যাচ্ছে না। এছাড়াও অনলাইনে পাঠদান জনপ্রিয় না হওয়ার আরো কয়েকটি কারণ চিহ্নিত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। এরমধ্যে হচ্ছে, প্রতিষ্ঠানগুলিতে সুবিধার অভাব এবং বেশিরভাগ শিক্ষার্থী গ্রামে থাকায় ইন্টারনেট ব্যবহারও অপ্রতুলতা। তবে কর্তৃপক্ষ বলছে, স্বাভাবিক পরিস্থিতি ফিরে আসার পরে শিক্ষার্থীদের ক্ষতি পোষাতে তারা অতিরিক্ত ক্লাস নেবে এবং বিভিন্ন ছুটি কমিয়ে দেবে।
জানতে চাইলে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব মো. মাহবুব হোসেন বলেছেন, বর্তমান পরিস্থিতিতে শিক্ষায় জুন পর্যন্ত কি পরিমান ক্ষতি হয়েছে তার একটি হিসাব আমরা করে রেখেছি। কিন্তু যদি সত্যি সত্যি সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ রাখতে হয় তাহলে আমাদের শিক্ষায় কী পরিমাণ ক্ষতি হবে তার হিসাব করা হয়নি। তবু আমরা কিছু পরিকল্পনা প্রণয়ন করার জন্য বলেছি। পরীক্ষা সংক্রান্ত বিষয়ে তিনি বলেন, জুন মাসে স্কুলগুলোর অর্ধবার্ষিক পরীক্ষা স্থগিত করা হয়েছে। একইসঙ্গে বছরের শেষে যে পরীক্ষা হবে সেখানেও সিলেবাস কমিয়ে দেয়ার চিন্তা ভাবনা চলছে। উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষার বিষয়ে তিনি বলেন, পরিস্থিতির কারণে সেপ্টেম্বরেও যদি উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা হয় সেক্ষেত্রে ৬০ দিনের পরিবর্তে আমরা ৪৫ দিনে ফলাফল দেয়ার চেষ্টা করব। সেই হিসেবে নভেম্বরের শেষ থেকে ডিসেম্বরের মধ্যে বিশ^বিদ্যালয়ে ভর্তি পরীক্ষা শেষ করার হিসাব করা হচ্ছে। অন্যদিকে, বছরের শেষে জেএসসি পরীক্ষা কিভাবে হবে সে বিষয়েও কাজ শুরু হয়েছে। তবে ক্ষতি পোষাতে আমরা যে পরিসংখ্যানই করি না কেন, আপাতত আমাদের সামনে অনলাইন ও টেলিভিশনে পাঠদান ছাড়া বিকল্প কিছু নেই এবং এটিই চালিয়ে যেতে হবে। বাকিটা ভবিষ্যত বলবে।
প্রাথমিক শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক মো. ফসিউলাহ বলেছেন, ঘরে বসে থাকলে তো চলবে না। কিছু একটা পথ বের করতে হবে। সেই পথটি কীÑএমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখনতো টেলিভিশনে প্রথম থেকে পঞ্চম শ্রেণির পাঠদান চলছে। কিন্তু টেলিভিশনের মাধ্যমে সবার কাছে পৌঁছানো যাচ্ছে না। সবার কাছে কিভাবে পৌঁছানো যায় বিকল্প চিন্তা শুরু হয়েছে।
নিম্নমাধ্যমিক, মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিক শিক্ষা টেলিভিশন, অনলাইনে পাঠদান করার মধ্য দিয়ে কিছুটা সচল রাখার চেষ্টা করা হলেও উচ্চশিক্ষা একেবারেই নীরব নিথর হয়ে আছে। সবমিলিয়ে করোনা মহামারিতে চলতি বছরের শিক্ষা ব্যবস্থা যেখানে অনিশ্চয়তার মুখে পড়েছে সেখানে আলো দেখাচ্ছে দেশের প্রথম সরকারি ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি ‘বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ডিজিটাল ইউনিভার্সিটি (বিডিইউ)। সরকারি বিশ্ববিদ্যালয়গুলো যেখানে অনলাইনে ক্লাস আয়োজনের ন্যূনতম ব্যবস্থ্া করতে পারছেনা আবার করলেও ক্লাশ হচ্ছে নামকাওয়াস্তে সেখানে দীর্ঘ এক মাস ধরে সপ্তাহে ৬ দিন সকাল ১১টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা অনলাইনে ক্লাস করছেন বিডিইউ‘র শিক্ষার্থীরা।
জানতে চাইলে বিশ^বিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. মুনাজ আহমেদ নূর বলেছেন, ঢাকা, রাজশাহী, জাহাঙ্গীরনগর, চট্টগ্রাম বিশ^বিদ্যালয়ের মতো বড় বিশ^বিদ্যালয়ের কাছে হয়তো অনলাইনে শিক্ষাদান একটি কঠিন বিষয়, তবে সত্যিকারের উদ্যোগী হলে কাজটি অসম্ভব নয় মোটেও এবং আমরা তা করে দেখিয়েছি।