করোনাবন্দিত্বে মানসিক সংকটে শিশুরা
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ১৩ মে ২০২০, ৪:৩২ অপরাহ্ণঝর্ণা মনি::
রাজধানীর একটি নামকরা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের সপ্তম শ্রেণির অত্যন্ত মেধাবী শিক্ষার্থী শ্রেয়া (ছদ্মনাম)। স্কুলে ক্লাসের ফাঁকে বন্ধুদের সঙ্গে হইহুল্লোড়, স্কুল শেষে বাসায় ফিরে খাওয়াদাওয়া শেষে একটু ভিডিও গেম খেলা। এরপর রয়েছে গানের ক্লাস, টিউশন স্যারের পড়াতে আসা। সময় যেন ডানা মেলে ফুরুৎ করেই উড়ে যায়। কিন্তু হঠাৎ করোনাঝড়ে এলোমেলো হয়ে যায় শ্রেয়ার মনোজগৎ। নাসার বিজ্ঞানী হওয়ার স্বপ্ন দেখা সাহসী মেয়েটি এখন মাঝরাতে ভয়ে-আতঙ্কে মাকে জড়িয়ে চিৎকার করে কেঁদে ওঠে। শান্ত স্বভাবের মেয়েটি প্রায়ই খাতা-কলম, ডাইনিং টেবিল থেকে ভাতের থালা ছুড়ে ফেলে দেয়। জন্মদিনে উপহার পাওয়া প্রিয় ট্যাবটিও ভেঙে ফেলেছে তুচ্ছ কারণে। শ্রেয়ার মা একজন বেসরকারি ব্যাংক কর্মকর্তা। এই লকডাউনেও তাকে অফিস করতে হয়। তিনি বলেন, মেয়ের অদ্ভুত এই আচরণে প্রথমে আমরা সবাই মুষড়ে পড়ি। পরে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের অনলাইনে পেইজে যোগাযোগ করি। তারা মেয়ের পাশাপাশি আমাদেরও কিছু কাউন্সিলিং করছেন। মেয়ে এখন আগের চেয়ে ভালো।
গত ৮ মার্চ বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হলে জনসমাগম এড়াতে ১৭ মার্চ থেকে দেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ করে সরকার। পর্যায়ক্রমে মেয়াদ বাড়িয়ে ১৫ মে পর্যন্ত করা হয়। তবে করোনাভাইরাসের অবস্থার উন্নতি না হলে সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকবে বলে জানিয়েছেন সরকারপ্রধান শেখ হাসিনা। এদিকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে বন্ধ করা হয়েছে জনসমাগম, বিনোদন, পর্যটন, মার্কেটসহ সব কিছু। বড়দের সঙ্গে শিশুরাও স্বেচ্ছা গৃহবন্দি হয়েছে। শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের তথ্যমতে, লকডাউনের কারণে প্রায় চার কোটি শিক্ষার্থী এখন ঘরে। এরমধ্যে প্রাথমিক পর্যায়ে পৌনে দুই কোটি এবং মাধ্যমিক পর্যায়ে এক কোটির ওপর। এতে শিশুদের মনজগতেও পড়ছে বিরূপ প্রভাব। শিশু মনে যেন ভয় ঘিরে ধরতে না পারে সে দিকেই বেশি নজর রাখতে হবে বলে মন্তব্য করেছেন মনোবিজ্ঞানীরা। তাদের পরামর্শ, ব্যস্ততার কারণে অন্যসময় অভিভাবকরা শিশুদের তেমন একটা সময় দিতে পারেন না। বরং এই সময়টাকে নষ্ট না করে অভিভবাবকরা পরিকল্পনামাফিক প্রতিটি মুহূর্তকে আনন্দঘন করে তুলতে পারেন।
ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগ চেয়ারপার্সন অধ্যাপক ড. মেহজাবীন হক বলেন, পরিবর্তিত সময়ের সঙ্গে এডজাস্ট করে চলতে বড়দেরই সমস্যা হচ্ছে। তবে বড়রা নিজেদের নিয়ন্ত্রণ করতে পারছেন আর ছোটরা পারছে না। ফলে সমস্যা তৈরি হচ্ছে। এক্ষেত্রে ছোটদের মনস্তত্তে¡ যেন কোনো ধরনের নেতিবাচক সমস্যা না পড়ে এজন্য পরিবারের বয়োজ্যেষ্ঠদেরই এগিয়ে আসতে হবে। ড. মেহজাবীন বলেন, এ সময় বাচ্চার সঙ্গে গল্প করুন। বাচ্চার কথা শুনুন। তার প্রতি আপনি আগ্রহ দেখান। বিভিন্ন বিষয় নিয়ে আলোচনা করুন। তার পছন্দের প্রতি দৃষ্টিপাত করুনÑযেমন তার স্কুল, বন্ধু বা যা পড়তে তার ভালো লাগে সেসব বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে। ঘরকে শিশুর জন্য আনন্দময় করে তুলতে হবে মন্তব্য করে এই চাইল্ড সাইকোলজিস্ট বলেন, এ সময় আমরা যতটা পারি শিশুদের ইনডোর গেম খেলতে পারি। বই পড়ার প্রতি শিশুর মনোযোগ বাড়াতে পারি। পারিবারিক সময় বের করে চায়ের আড্ডার ফাঁকে ছোটখাটো অনুষ্ঠান করে শিশুদের একঘেঁয়েমি দূর করতে পারি। পাশাপাশি সংসারের টুকিটাকি কাজেও তাদের উৎসাহিত করতে পারি। তবে কোনোভাবেই অযথা তাদের বকাঝকা করা যাবে না। একই কথা বারবার বলা যাবে না। এতে তারা বিরক্ত হয়ে নেতিবাচক আচরণ শুরু করবে। করোনামহামারিতে এডুকেশনাল অ্যান্ড কাউন্সিলিং সাইকোলজি বিভাগের অনলাইন পেজ থেকে বিনামূল্যে সার্বক্ষণিক সব বয়সি মানুষের সেবা দেয়া হচ্ছে বলেও জানান তিনি।
মনোবিজ্ঞানীদের মতে, সামাজিক দূরত্ব বজায় রাখার কারণে স্কুলে যেতে না পারা, ঘরের বাইরে বন্ধুদের সঙ্গে খেলতে বা বেড়াতেও যেতে না পারা, তার উপরে করোনার কারণে মৃত্যু আতঙ্কে শিশু মনে ভয় তৈরি হয়ে বাড়ছে মানসিক চাপ। এসব কারণে অনেক শিশুর মধ্যেই একঘেঁয়েমি, অস্থিরতা বা মেজাজ খিটখিটে দেখা দিতে পারে। তাদের মধ্যে জেদ বাড়তে পারে। শিশুদেরকে এই মনো-সামাজিক হতাশা থেকে বের করে আনন্দঘন সময়ে নিয়ে যাওয়ার দায়িত্ব পরিবারের। এ ব্যাপারে জাতীয় মানসিক স্বাস্থ্য ইনস্টিটিউটের ক্লিনিক্যাল সাইকোলজিস্ট ও বাংলাদেশ ক্লিনিক্যাল সাইকোলজি সোসাইটির সাধারণ সম্পাদক মো. জহির উদ্দিন বলেন, তাদের মস্তিষ্ককে একটু ঘুরিয়ে দিতে হবে। আগে স্কুল, বন্ধুরা আর খেলাধুলায় সময় পার হতো। এখন সময় দেবেন পরিবারের সিনিয়র সদস্যরা। সবচেয়ে ভালো হয় পরিবারে বয়স্ক কেউ থাকলে। শিশুরা তাদের কাছে থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে। তিনি বলেন, শুধু শিশুরাই নয়, পরিবারের অন্যান্য সদস্যও কাজের ফাঁকে বিভিন্ন ইনডোর গেম, একটু গান, কবিতা বা গল্পের আসর জমাতে পারেন। পাশাপাশি বাচ্চাদের পড়াশোনায় সময় দিতে হবে। নতুবা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান খোলার সঙ্গেসঙ্গেই তারা সমস্যায় পড়বে। এছাড়া এই সময়টাই সবাইকে পুষ্টিকর খাবার খেতে হবে, যেন শরীরে পুষ্টির ঘাটতি না হয়। নতুবা মেজাজ খিটখিটে থাকবে।
জানতে চাইলে ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সাইকোলজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ও চাইল্ড সাইকোলজিস্ট আরিফা রহমান বলেন, শিশুর মনোজগৎ অনেক সময় নির্ভর করে পরিবারে কি ধরনের পরিবেশ বিরাজ করছে তার ওপর। পরিবারের সদস্যদের মধ্যে আচরণ নেতিবাচক হলে শিশুর আচরণও নেতিবাচক হবে। আর এই করোনা সংকটেও যদি পরিবারের সবাই ধীরস্থির থাকেন, এটি তাদের মধ্যে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। বর্তমান পরিস্থিতি সম্পর্কে সে জানবে, তবে তাদের আতঙ্কে রাখা যাবে না। কারণ এতে সুদূরপ্রসারী নেতিবাচক প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে। পরিস্থিতি যখন স্বাভাবিক হবে তখনও তার মধ্যে আতঙ্ক রয়ে যাবে। তিনি বলেন, শিশুদের সব সংবাদ শোনার প্রয়োজন নেই। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমেও এত বেশি ঘাটাঘাটি না করে কার্টুন, ভিডিও গেম, শিশুতোষ গল্প, ছড়া এসবে মনোযোগ বাড়ানো উচিত। সেইসঙ্গে তাদের দায়িত্বশীল করে গড়ে তোলার জন্য এখন থেকেই টুকিটাকি সহায়তার কাজে উৎসাহ দেয়া যেতে পারে।
এদিকে করোনাসংকটে শিশু মনোজগতে যেন নেতিবাচক প্রভাব বিস্তার না করতে পারে সেজন্য বেশ কিছু পরামর্শ দিয়েছে বিশ^স্বাস্থ্য সংস্থা। সংস্থাটির মতে, সন্তানকে শরীরচর্চা করাতে পারেন। সন্তানের সঙ্গে খেলায় সঙ্গ দিন। ওদের সঙ্গে খেলতে খেলতে বাড়ির বড়দেরও খানিকটা শরীরচর্চা হয়ে যাবে। পড়াশোনার বাইরে অবসর সময় কাটানোর জন্য সন্তানের হাতে মোবাইল ফোনের পরিবর্তে তুলে দিন গল্পের বই। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার নির্দেশনা অনুযায়ী, পাঁচ বছরের কম বয়সী শিশু টিভি, মোবাইল বা কম্পিউটারে সঙ্গে যতটা কম সময় কাটাবে, ততই ভালো। পাঁচ বছরের কম বয়সি শিশুরা দিনে বড়জোড় ১ ঘণ্টা টিভি বা কম্পিউটারের সঙ্গে সময় কাটাতে পারে।