দেশের সোয়া কোটি প্রবাসীর পরিবার শঙ্কায়: ঘরেঘরে চলছে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মে ২০২০, ৫:১৭ অপরাহ্ণসালাম মশরুর::
করোনার থাবা পড়েছে প্রবাসীদের ওপরও। গেল ৩ মাসে লন্ডভন্ড হয়ে গেছে জীবনব্যবস্থা। এপর্যন্ত বিশ্বের ১৭ টি দেশে করোনায় আক্রান্ত হয়ে ৫৯০ জন বাংলাদেশির মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে। আক্রান্ত আছেন ৫০ হাজারেরও অধিক। দেশেবিদেশে প্রবাসী ও প্রবাসী পরিবারে সদস্যরা উদ্বেগ-উৎকন্ঠায় সময় কাটাচ্ছেন। মাত্র ক’দিনেই পৃথিবীর রূপ পাল্টে গেছে। প্রবাসীদের উপার্জন শুধু নিজেদের জীবনচালিকা নয়, দেশের অর্থনীতিতেও বিরাট ভূমিকা রেখে আসছে। বর্তমান করোনা পরিস্থিতি বিশ্বের সর্বত্র প্রবাসীদের রোজগারের ওপর আঘাত হেনেছে। এ নিয়ে প্রবাসীদের পাশাপাশি দেশে অবস্থানরত প্রবাসী পরিবারের সদস্যরাও শঙ্কায় দিন কাটাচ্ছেন। ঈদকে সামনে রেখে কেনা কাটাসহ নানান প্রস্তুতিতে যখন সময় কাটানোর কথা, তখন ঘরে ঘরে চলছে জীবন বাঁচানোর সংগ্রাম।
এবার বিশ্বে আনন্দবিহীন ঈদ। ঈদ আনন্দ উপভোগ করার মুহূর্তে আনন্দের পরিবর্তে নিরানন্দের রেশ কতটা কঠিন ও কতকাল বয়ে নিয়ে যেতে হবে, এই ভাবনাই ভাবতে হচ্ছে সকলকে। মুসলিম জাহানের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব ঈদ। পৃথিবীর মুসলমানদের কাছে ঈদের তাৎপর্য ও গুরুত্ব অপরিসীম। রমজান মাসকে ঘিরেই ঈদ-আনন্দের আবহ তৈরি হয়ে থাকে। পুণ্য লাভের মাস রমজান। রমজান মাসের শুরু থেকেই আমাদের জীবনব্যবস্থায় এক ধরনের পরিবর্তন আসে। সারা বিশ্বের সাথে বাংলাদেশেও রমজানকে ঘিরে মানুষের একটি প্রস্তুতি থাকে। ধনী-গরিব নির্বিশেষে ঈদ উৎসব পালনের আয়োজন সারা বছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আনন্দের ও ব্যয় বহুল। করোনাকালীন এই মুহূর্তে ঈদের আনন্দ ও প্রস্তুতির চেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে খেয়ে বেঁচে থাকা।
ঈদ মৌসুমে অন্য সময়ের চেয়ে অধিক পরিমাণে টাকা-পয়সা বিদেশ থেকে দেশে এসে থাকে। দেশের প্রায় সোয়া কোটি লোক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছেন। কম বেশ প্রতিনিয়ত তাদের কাছ থেকে টাকা আসছে দেশে। আর প্রবাসীদের প্রেরিত এই রেমিট্যান্স দেশের অর্থনীতিকে চাঙা করে চলেছে। সিলেট জেলার প্রায় ১০লাখ লোক বিশ্বের বিভিন্ন দেশে কর্মরত আছেন। এর মধ্যে উল্লেখযোগ্য হচ্ছে ব্রিটেন। সেখানে প্রায় ৫ লক্ষাধিক লোক অবস্থান করছেন। ব্রিটেন, আমেরিকা, মধ্যপ্রাচ্যসহ অন্যান্য স্থান থেকে অনেক প্রবাসীর প্রেরিত অর্থ দ্বারা এদেশীয় পোষ্যদের দৈনন্দিন ব্যয় নির্বাহ হয়ে থাকে। বিদেশ থেকে অনেক প্রবাসী প্রতি মাসেই দেশে বসবাসরত পরিবারের সদস্যদের খরচের টাকা পাঠিয়ে থাকেন। বিদেশ থেকে আসা অর্থ দিয়ে পোষ্যরা স্বাচ্ছন্দেই জীবনযাপন করে আসছেন। বর্তমান পরিস্থিতিতে বিদেশে হঠাৎ করে করোনা নিয়ে সৃষ্ট জীবনযাপনের সীমাবদ্ধতা, বেকারত্ব, চাকরির ক্ষেত্রে অনিশ্চয়তা, ব্যবসায় মন্দাভাব, কাজের অভাবসহ নানান সমস্যায় চলার গতি ঝিমিয়ে পড়েছে। এবার ঈদ মৌসুমে তুলনামূলক ভাবে বিদেশ থেকে অর্থ প্রেরণের পরিমাণ একেবারে কম।
সিলেট বিভাগের বিভিন্ন এলাকার প্রবাসী পরিবারগুলোতে বিরাজ করছে অনিশ্চয়তা ও আতঙ্ক। সিলেটের বালাগঞ্জ, বিশ্বনাথ, বিয়ানীবাজার, ফেঞ্চুগঞ্জ, জগন্নাথপুরসহ অন্যান্য এলাকার বিপুল সংখ্যক লোক প্রবাসে রয়েছেন। নানা প্রতিকূলতার মধ্যেও বর্তমান ঈদ মৌসুমে বিদেশ থেকে নিজেদের পরিবারের নিকট অনেকেই যথাসাধ্য অর্থ পাঠানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন।
বিদেশ থেকে প্রেরিত টাকা উত্তোলন করতে গিয়ে তারা নানান হয়রানির শিকার হচ্ছেন। করোনা পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকিং কার্যক্রম সীমিত আকারে পরিচালিত হওয়ার অজুহাতে ব্যাংকগুলোতে গ্রাহকদের হয়রানি বৃদ্ধি পেয়েছে। গ্রাম এলাকার ব্যাংকগুলোর সেবা কার্যক্রম বন্ধ থাকায় নগরীর কিছু সংখ্যক ব্যাংক শাখার উপর চাপ সৃষ্টি হয়েছে। করোনার বিধিনিষেধ রক্ষা করতে গিয়ে গ্রাহকদের ব্যাংকে প্রবেশেও নিয়ম মানতে হচ্ছে। অন্যান্য কাজের পাশাপাশি বিদেশ প্রেরিত অর্থ গ্রহণের জন্য আগতদের উপস্থিতিতে বিভিন্ন ব্যাংকে ভিড় জমে থাকে। অনেক ব্যাংক শাখার বারান্দায় দাড়ানোরও জায়গা নেই। এ নিয়ে মহিলা পুরুষ গ্রাহকদের বাড়তি ঝামেলা পোহাতে হচ্ছে। বিভিন্ন ব্যাংকে দীর্ঘক্ষন লাইনে দাড়িয়ে ভেতরে প্রবেশের পূর্বেই ব্যাংকিং সময় শেষ হয়ে যাওয়ার কারণ দেখিয়ে গ্রাহকদের ফিরিয়ে দেয়া হচ্ছে। এছাড়া বিভিন্ন ব্যাংকে বিদেশ থেকে প্রেরিত অর্থ ট্রান্সফার সংক্রান্ত তথ্য যাচাই-বাছাই নিয়ে যথাযথ গুরুত্ব প্রদানে অবহেলা ও খামখেয়ালির ঘটনায় গ্রাকদের ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে। ব্যাংকিং সেবা নিয়ে জটিলতার কারণে করোনার এই সময়ে বিশেষ করে গ্রাম এলাকা থেকে আগত গ্রাহক অহেতুক হয়রানির শিকার হচ্ছেন। গ্রাম এলাকা থেকে অধিক গাড়ি ভাড়া পরিশোধ করে একাধিক বার নগরীর ব্যাংকে আসা যাওয়ায় একদিকে যেমন ভোগান্তি পোহাচ্ছেন, অপর দিকে আর্থিকভাবেও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছেন। বর্তমান ঈদ মৌসুমে ব্যাংকের সেবার মান ও সময়সীমা বৃদ্ধির পাশপাশি গ্রাম এলাকার শাখাগুলোকেও সেবা প্রদানের আওতায় নিয়ে আসা প্রয়োজন বলে ভুক্তভোগীরা মনে করছেন।
বিশ্বের লকডাউন পরিস্থিতিতে দেশের আত্মীয়স্বজনদের কাছে রেমিট্যান্স পাঠাতে অনলাইন-টু-ওয়ালেট সেবার দিকে এগিয়ে গেছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। বিশেষ করে বাইরে যেতে বিধিনিষেধের কারণে প্রবাসদের ঘরে অবস্থান করতে হচ্ছে। একই ভাবে দেশেও প্রবাসী পরিবারের সদস্যরা বাইরে যেতে পারছেন না। এই অবস্থায় অর্থ প্রেরণকারী বাইরে না গিয়ে তার নিজের মোবাইল থেকে অনলাইন অথবা ওয়ালেটভিত্তিক মানি ট্রান্সফার সেবা থেকে নির্ধারিত ব্যাংকিং চ্যানেল হয়ে দেশে তার স্বজনের বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাচ্ছেন। ফলে স্বাভাবিক সময়ের চেয়ে এই সময়ে বিকাশ অ্যাকাউন্টে রেমিট্যান্স আসার পরিমাণ অনেক বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। বিকাশ দেশের ৬টি বেসরকারি ব্যাংকের মাধ্যমে বাংলাদেশ ব্যাংকের তত্ত¡াবধানে বিশ্বের বিভিন্ন দেশ থেকে রেমিট্যান্স গ্রহণের সেবা দিয়ে যাচ্ছে।
বিকাশ সূত্র জানিয়েছে, চলতি বছরের জানুয়ারি থেকে এপ্রিলের ১৮ তারিখ পর্যন্ত কেবল বিকাশেই প্রায় ১৩৮ কোটি টাকা রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। কোভিড-১৯ এর এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তে অনলাইন ও ওয়ালেটভিত্তিক মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানগুলোর মাধ্যমে এ বছরের শুরুর তিন মাসের তুলনায় এপ্রিল মাসে গড়ে প্রতিদিন প্রায় ১৫০ শতাংশ পর্যন্ত বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। বিকাশে সবচেয়ে বেশি রেমিট্যান্স আসছে মালেশিয়া, সিঙ্গাপুর, দক্ষিণ কোরিয়া, মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপ ও যুক্তরাজ্য থেকে। ওয়ালেটভিত্তিক বিভিন্ন সেবা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিকাশের কৌশলগত অংশীদারত্বের ফলে কোভিড-১৯-এর এই সময়েও এসব দেশে অবস্থানরত প্রবাসীরা তাদের মোবাইল ওয়ালেট থেকে কয়েক মুহূর্তেই দেশে স্বজনদের বিকাশ অ্যাকাউন্টে টাকা পাঠাতে পারছেন। এই কঠিন সময়েও ওর্য়াল্ড রেমিট, ট্রান্সফারওয়াইজ, রিয়া, গালফ এক্সচেঞ্জ, বাহরাইন ফিন্যান্স কোম্পানি (বিএফসি), ব্র্যাক সাজন, সিবিএল মানি ট্রান্সফার, অগ্রণী এক্সচেঞ্জ, এনবিএল এক্সচেঞ্জ সহ বিশ্বের শীর্ষ ৩৪টি মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে বিকাশের অংশীদারত্বের সুবাদে ৮০টির বেশি দেশ থেকে সহজেই বাংলাদেশে স্বজনের কাছে অর্থ পাঠানোর পথ উš§ুক্ত রয়েছে।
বিকাশ সূত্র বলছে, আন্তর্জাতিক মানি ট্রান্সফার প্রতিষ্ঠান ওর্য়াল্ড রেমিট ও ট্রান্সফারওয়াইজ এর মাধ্যমে যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, যুক্তরাষ্ট্রসহ পুরো ইউরোপ থেকে বিকাশে টাকা পাঠানোর সেবা গ্রহণের মাত্রা এই বিশেষ সময়ে এসে বেড়েছে। অন্যদিকে দেশে প্রবাসীদের স্বজনরা ব্যাংকে না গিয়ে সামাজিক দূরত্ব রক্ষা করে রেমিট্যান্সের অর্থ প্রয়োজন অনুসারে ক্যাশআউট করা, সেন্ড মানি করা, পেমেন্ট দেয়া, বিল দেয়া, মোবাইল রিচার্জ করাসহ আরও অনেক প্রয়োজনে ব্যবহার করতে পারছেন এবং নিরাপদে থাকতে পারছেন। প্রেরিত অর্থের ওপর সরকার ঘোষিত ২ শতাংশ আর্থিক প্রণোদনা এই কঠিন পরিস্থিতির মধ্যেও প্রবাসীদের মোবাইল ব্যাংকিং চ্যানেলে রেমিট্যান্স পাঠানোতে আরও বেশি উদ্বুদ্ধ করছে বলে জানিয়েছে আর্থিক সেবাদাতা প্রতিষ্ঠান বিকাশ। এছাড়া যেসব প্রবাসীরা বিকাশের মাধ্যমে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন, তাদের জন্য বিনামূল্যে স্বাস্থ্যসেবার উদ্যোগ নিয়েছে বিকাশ ও ডিজিটাল হেলথকেয়ার। এই কার্যক্রমের আওতায় প্রবাসীর পরিবারের সদস্যরা ঘরে থেকেই জরুরি প্রয়োজনে তিন মাসে ৯০ মিনিট পর্যন্ত ফোনে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের সেবা নিতে পারবেন।
যাদের হাসপাতালে ভর্তি হতেই হবে তারা পরবর্তীতে হাসপাতাল থেকে ছাড়া পাওয়ার পর সর্বোচ্চ ৮ হাজার টাকা পর্যন্ত নগদ সহায়তা পেতে পারবেন। কোভিড-১৯ আক্রান্ত রোগী যারা বাড়িতে অবস্থান করে সেবা নিচ্ছেন তারা ২ হাজার টাকা এই প্যাকেজের আওতায় সহায়তা দারি করতে পারবেন। দুর্ভাগ্যজনকভাবে মৃত্যু হলে অ্যাকাউন্টধারী ব্যক্তির নমিনিকে দশ হাজার টাকা ক্ষতিপূরণ দেয়া হবে এই প্যাকেজের আওতায়। প্রবাসীদের স্বজনদের নিরাপদ রাখতে বিকাশ অ্যাকাউন্টে যেসব গ্রাহক রেমিট্যান্স পান তাদের কাছ থেকে আইভিআর কলের মাধ্যমে এই ইন্স্যুরেন্স সেবা গ্রহণের সম্মতি নিয়ে সম্পূর্ণ বিনামূল্যে সেবাগুলো দেয়া হচ্ছে। গ্রাহক সম্মতি দিয়ে নিবন্ধনের পুরো প্রক্রিয়াটি সম্পন্ন করেই কেবল সেবাটি নিতে পারবেন।
মহামারি করোনাভাইরাসের কারণে এখন পুরো বিশ্ব অচল হয়ে পড়েছে। ব্যবসা-বাণিজ্য প্রায় বন্ধ। ঘর থেকে বের হতে পারছে না মানুষ। রেমিট্যান্স পাঠানোর ক্ষেত্রে তৈরি হয়েছে প্রতিবন্ধকতা । ফলে দেশের অর্থনীতির সূচকগুলোর মধ্যে আশা জাগানো প্রবাসী আয়ে ধাক্কা লেগেছে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের অচলাবস্থায় বেকার হয়ে পড়ছেন অনেক প্রবাসী। সামনের দিনগুলো নিয়ে ভাবতে হচ্ছে প্রবাসীদের। এই কঠিন সময়ে রেমিট্যান্সের নেতিবাচক ধারা অব্যাহত থাকবে বলে আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। এদিকে বেশিরভাগ দেশে সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় যথটা সাধ্য প্রবাসীরা দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে গিয়েও সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন। কিছু কিছু দেশ থেকে অনলাইনে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ থাকলেও দক্ষতার অভাবে তা কাজে লাগাতে পারছে না অনেকে। এব্যাপারে বিশ্বের বিভিন্ন স্থানে অবস্থানরত প্রবাসীদের সাথে আলাপ করে জানা যায়, মার্চের শুরু থেকেই অনেক দেশ অবরুদ্ধ। সব মানুষ ঘরে বন্দি। দোকান-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান খুলছে না। কাজ নেই, আয়ের পথও বন্ধ। এভাবে আর কিছুদিন চলতে থাকলে নিজেদের খরচ মেটানোই দায় হয়ে যাবে।
সুনামগঞ্জের বাসিন্দা আব্দুল খালিক পাঁচ বছর ধরে সৌদি আরবে থাকেন। মক্কা নগরীর একটি রঙে কারখানায় কাজ করেন। ফেব্রæয়ারি মাস থেকেই বন্ধ কাজকর্ম। মার্চে ওমরা বন্ধ করায় কাজ বন্ধ হয়ে গেছে। তিন সপ্তাহ ধরে বেকার। ঘর থেকে বের হতে পারেন না। মালিকের কাছে কিছু টাকা পাওয়া ছিল। সেটা নিয়ে কোনো রূপ এক মাস চালিয়েছেন। তিনি বলেন, মা-বউ-বাচ্চা দেশে আছে। তাদের খরচ পাঠানো দরকার। কিন্তু কাজ বন্ধ নিজেরই থাকা খাওয়ার খরচ নেই, দেশে টাকা পাঠাবো কীভাবে। এছাড়া সব বন্ধ, বের হলে পুলিশি ঝামেলা পোহাতে হয়। তাই বাইরে না গিয়ে ঘরেই সময় কাটাচ্ছি।
দেশের রেমিট্যান্স আহরণের সবচেয়ে বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দেশ সৌদি আরব। দেশটিতে অবস্থানকারী বাংলাদেশিরা জানান, অনির্দিষ্টকালের জন্য দোকানপাট অফিস-আদালত ব্যবসা প্রতিষ্ঠান বন্ধ। গৃহবন্দি হয়ে আছেন সবাই। এর ফলে রেমিট্যান্স পাঠাতে পারছে না প্রবাসীরা। অনলাইনে রেমিট্যান্স পাঠানোর সুযোগ থাকলেও তা অনেকে বোঝেন না। এর ফলে দেশে অর্থ পাঠাতে পারছেন না। এছাড়া সব ধরনের প্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় এখানকার প্রবাসীদের অনেকের কাজ নেই। কষ্টে দিনযাপন করছেন। এ অবস্থা আর কিছু দিন চললে এ দেশে থাকাই দায় হয়ে যাবে।
কাতারে অনির্দিষ্টকালের জন্য বন্ধ রয়েছে সরকারি-বেসরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান। বন্ধ রয়েছে মানি এক্সচেঞ্জ প্রতিষ্ঠানগুলো। এতে বাধ্য হয়ে হুন্ডি আর বিকাশে টাকা পাঠাচ্ছেন প্রবাসীরা। তবে কাতার থেকে অনলাইনে রেমিট্যান্স পাঠানো চালু থাকলেও কীভাবে টাকা পাঠাতে হয় জানেন না অনেক প্রবাসী। অবৈধ পথে টাকা যাওয়ায় দেশের রেমিট্যান্স প্রবাহ কমে যাচ্ছে। সেখানকার প্রবাসীরা জানান এই অবস্থায় অনলাইনে টাকা পাঠানোর সহজ উপায় বিজ্ঞপ্তি আকারে প্রকাশের জন্য তারা বাংলাদেশ দূতাবাসকে অনুরোধ জানিয়েছেন। প্রবাসী শফিক বলেন, ২৩বছরের কাতার জীবনে কোনোদিন অবৈধ পথে টাকা পাঠাননি। কিন্তু করোনাভাইরাসের কারণে বিকাশে টাকা পাঠাতে বাধ্য হয়েছেন। বর্তমানে ঘরে বসে অনলাইনের মাধ্যমে সহজে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাতে বাংলাদেশিদের দিঙ্নির্দেশনা দিচ্ছেন মানি এক্সচেঞ্জে কর্মরত প্রবাসীরা।
মহামারি করোনাভাইরাস আঘাত হেনেছে প্রবাসীদের রোজগারের উপর। গেল মার্চ মাসে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসী বাংলাদেশিরা। যা গত বছরের মার্চের তুলনায় ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। বর্তমানে দেশে রেমিট্যান্স পাঠানোর প্রক্রিয়া মুখ থুবড়ে পড়েছে। ফলে দেশের জিডিপিতে প্রায় ১২ শতাংশ অবদান রাখা প্রবাসী আয়ে ধাক্কা লেগেছে। বিশ্বের অনেক দেশে অচলাবস্থার কারণে বেকার হয়ে যাচ্ছেন প্রবাসীরা। এর ফলে রেমিট্যান্সে খুব শিগগিরই উন্নতি হবে বলে মনে করছেন না খাত সংশ্লিষ্টরা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের মার্চে দেশে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স এসেছে তা গত ১৫ মাসের মধ্যে সর্বনিম্ন। এর আগে গত বছরের ডিসেম্বর মাসে ১২০ কোটি ৬৯ লাখ ডলারের রেমিট্যান্স এসেছিল। মার্চে রেমিট্যান্স এসেছে ১২৮ কোটি ৬৮ লাখ ডলার। যা গত বছরের মার্চ মাসের চেয়ে ১৩ দশমিক ৩৪ শতাংশ কম। গত বছর একই সময় দেশে রেমিট্যান্স এসেছিল ১৪৫ কোটি ৮৫ লাখ ডলার। ফেব্রæয়ারিতেও তুলনামুলক রেমিট্যান্স ১২ দশমিক ৮৪ শতাংশ কমেছে। সেসময় দেশে রেমিট্যান্স আসে ১৪৫ কোটি ২২ লাখ ডলার। এপ্রিলে এসেছে ৯৫ কোটি ডলারের মতো। গেল বছরের একই সময়ে যা ছিল ১৪৩ কোটি ৪৩ লাখ ডলার।
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত ২০১৮-১৯ অর্থবছরে দেশে রেমিট্যান্স আহরণে রেকর্ড হয়। ওই সময়ে প্রবাসীরা ১ হাজার ৬৪২ কোটি ডলার রেমিট্যান্স পাঠিয়েছে। যা অর্থবছর হিসাবে বাংলাদেশের ইতিহাসে সর্বোচ্চ রেমিট্যান্স আহরণ। মে মাস পর্যন্ত রেমিট্যান্স অর্জন সবমিলিয়ে ২০১৯-২০ অর্থবছরের সাড়ে ছয় মাসে (২০১৯ সালের ১ জুলাই থেকে ২০২০ সালের ১৫ জানুয়ারি) এক হাজার ৩০ কোটি (১০.৩৬ বিলিয়ন) ডলারের রেমিট্যান্স পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা।
করোনার অস্থিরতায় দ্রæত পরিবর্তন হচ্ছে সকল হিসাবনিকাশ। আশঙ্ককাজনকভাবে কমছে প্রবাসী আয়। এ বছরের প্রথম ৩ মাসে দেশে ফিরে এসেছেন প্রায় ৭ লাখ বাংলাদেশি। সেই হিসাবে বিভিন্ন দেশে এখনও রয়েছেন প্রায় ৯৩ লাখ প্রবাসী। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্যমতে, এ বছরের প্রথম ২ মাসেও প্রবাসী আয় এসেছিল গেল বছরের একই সময়ের চেয়ে বেশি। বিশ্ব ব্যাংকের মতে কোভিড-১৯ মাহামারিতে এ বছর সারাবিশ্বে রেমিট্যান্স কমবে ২০ শতাংশ। তবে বাংলাদেশে কমতে পারে ২২ ভাগের মতো। তাই বেসরকারি গবেষণা সংস্থা সিপিডির মতে, সামনের দিনে নতুন কর্মসংস্থান তৈরিতে সরকারকে হতে হবে বিশেষ মনোযোগী। তবে রেমিট্যান্স ধ্বসের পরও আমদানি ব্যয় কমার কারণে বাংলাদেশ ব্যাংকে বিদেশি মুদ্রার রিজার্ভ ছাড়িয়েছে ৩ হাজার ৩শ কোটি ডলার।
এদিকে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বেকারের কোটায় সংখ্যা বুদ্ধি পাচ্ছে। গত ১৫দিনে আরো ৩০ লাখ আমেরিকান বেকার ভাতার আবেদন করায় মধ্য মার্চ থেকে ১৪ মে পর্যন্ত বেকার হওয়া আমেরিকানের সংখ্যা ৩ কোটি ৬৫ লাখে দাড়িয়েছে বলে মার্কিন শ্রম দফতর জানিয়েছে। করোনা ভাইরাসে ক্ষতবিক্ষত আমেরিকায় স্বল্প ও মাঝারি আয়ের কর্মজীবীরা এখন মহাসংকটে পড়েছে বলে ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংকের সর্বশেষ এক জরিপে তা উদঘাটিত হয়েছে। গত সপ্তাহে প্রকাশিত এক জরিপ ফলাফলে দেখা গেছে, বার্ষিক ৪০ হাজার ডলারের কম মজুরির কর্মচারির ৪০% ১৮ মার্চের পরই বেকার হয়ে পড়েছেন। আর যাদের বার্ষিক বেতন ৪০ হাজার থেকে এক লাখ ডলারের মধ্যে তাদের ১৯% এবং এক লাখ ডলারের অধিক বেতনের কর্মকর্তার ১৩% বেকার হয়েছেন। অবশিষ্ট কর্মচারী-কর্মকর্তারা বাসায় বসে অথবা জরুরি প্রয়োজনের অফিস-সংস্থা-ব্যবসা প্রতিষ্ঠান হওয়ায় তারা পূর্ণ বেতন পাচ্ছেন এবং এ শ্রেণির ৮৫% তাদের বাসা ভাড়া, ফোন, বিদ্যুৎ, ইন্টারনেট বিলসহ মর্টগেজ পরিশোধেও কোনো সংকটে নেই। আর যাদের মজুরী কমানো হয়েছে তাদের পক্ষে মাসিক ব্যয়-নির্বাহ করা কঠিন হয়ে পড়েছে বলেও জরিপে উদঘাটিত হয়েছে। করোনাভাইরাসের কারণে বেকার হওয়া ৩ কোটি ৬৫ লাখের পরিবারের সদস্যরাও নাজুক অবস্থায় নিপতিত হয়েছেন। এসব পরিবারের শিশু-কিশোর-তরুণ-তরুণীরা পুষ্টিকর খাদ্য থেকেও বঞ্চিত হচ্ছে। বেকারের এই তালিকায় বাংলাদেশিরাও রয়েছেন। বর্তমান পরিস্থিতির পরিপ্রেক্ষিতে ফেডারেল রিজার্ভের চেয়ারপার্সন জেরোমি এইচ পাওয়েল উদ্বেগের সাথে বলেছেন, যুক্তরাষ্ট্র কঠিন এক অর্থনৈতিক সংকটে নিপতিত হয়েছে যার কোনো উদাহরণ বা দৃষ্টান্ত নেই। এহেন অবস্থা থেকে পরিত্রাণের জন্যে কংগ্রেস এবং হোয়াইট হাউজকে সম্মিলিতভাবে পদক্ষেপ গ্রহণের প্রয়োজনীয়তা অনুভব করেছেন পাওয়েল।
করোনা ভয়াবহতায় নিউইয়র্কের জেকসন হাইটসে গত ২০ মার্চে থেকে জনতা ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ ও ব্যাংক এশিয়া মানি এক্সচেঞ্জ বন্ধ হয়ে যায়। তবে ২মে থেকে অন্যান্য মানি এক্সচেঞ্জ খোলা হয়। গত ২০ মার্চ থেকে পয়লা মে পর্যন্ত সব মানি এক্সচেঞ্জ বন্ধ থাকায় এবার কোনো মানি এক্সচেঞ্জ তাদের লক্ষমাত্রা অর্জন করতে পারবে না বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা। এছাড়া করোনার কারণে বিশেষ করে যারা গাড়ি চালক এবং আনডকুমেন্টেটেডরা এখন খারাপ সময় পার করায় রেমিট্যান্স প্রেরণে প্রভাব পড়বে বলে মনে করেন এই খাতের ব্যবসায়ীরা। ২ মে থকে ১১মে পর্যন্ত স্ট্যান্ডার্ড এক্সপ্রেস মানি এক্সচেঞ্জ প্রেরণ করেছে ৩৫ লাখ ডলার, রূপালী এক্সচেঞ্জ প্রেরণ করেছে ৩৪ লাখ ৭ হাজার ডলার, সোনালী ব্যাংক মানিএক্সচেঞ্জ প্রেরণ করেছে ৯ লাখ ৮৩ হাজার ডলার, ন্যাশনাল ব্যাংক মানি এক্সচেঞ্জ প্রেরণ করেছে একলাখ ৫০ হাজার ডলার।
রমজান এবং পবিত্র ঈদুল ফিতরকে সামনে রেখে এখন মানিএক্সচেঞ্জ গুলোতে ভিড় থাকলেও অন্য বছরের তুলনায় কম। প্রতি বছর এই সময়ে দেশে রেমিটেন্স প্রেরণ সবচেয়ে বেশি হয়ে থাকে বলে জানিয়েছেন মানি এক্সচেঞ্জ এর সাথে জড়িতরা। ব্যবসায়ীরা জানান, রেমিট্যান্স যারা পাঠায় তাদের একটি বড় অংশ ইয়েলো ক্যাব ড্রইভার, উবার ড্রাইভারসহ আনডকুমেন্টেটেড প্রবাসী। বর্তমানে এই প্রবাসীরা নানা সমস্যায় জর্জরিত। গত ৫০দিন বন্ধ থাকায় অন্তত কোটি ডলার লোকসান হয়েছে।