চর্বিত নির্যাস (০৪)
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৭ মে ২০২০, ৬:৪৭ অপরাহ্ণঅন্যান্য রমজান মাস আর এবারের রমজান মাসে ব্যবধান অনেক। শতাব্দির ভয়ংকর করোনার ভয়ংকর গ্রাসে অবিরাম প্রাণহানি ঘটছে সমগ্র বিশ্বজুড়ে। থমকে আছে মুসলিম বিশ্ব। মাসাধিককালের ঘরবন্দি মানুষ যেতে পারছে না বাইরে। ইফতার-সেহরি ও ঈদকে কেন্দ্র করে পুরো এই মাসের গুরুত্ব মুসলিমদের কাছে অত্যন্ত গুরুত্ববহ। কিন্তু এবারের অবস্থান সম্পূর্ণ ভিন্ন। বাইরে গেলে সংক্রান্ত হবার ভয়, প্রতিদিনই মৃত্যুর খবর লাশের খবর। কেউ কাউকে দেখতে যেতেও পারছে না। মৃত্যুর পর দাফন জানাজায়ও যাওয়া সম্ভব নয়। এই উৎকন্ঠা নিয়ে শুরু হলো পবিত্র রমজান মাস। মানুষ এখনো জানে না কবে এই মরণব্যাধির ভ্যাক্সিন আবিষ্কার হবে, যদিও এই ব্যাপারে থেমে নেই বিশে^র বাঘা বাঘা বিজ্ঞানীকুল। ইতোমধ্যে বিভিন্ন সফলতার খবর আসলেও চুড়ান্ত প্রতিষেধক আবিস্কারের কোন খবর এখনো সুদূরপরাহত। মানুষ এখনো সম্পূর্ণ অনিশ্চয়তার মাঝে উৎকন্ঠা নিয়ে কাটাচ্ছে দিন। আমাদের দেশে চলমান সমাজ ব্যবস্থায় সংকট ভয়াবহ। অসচেতনতা অশিক্ষা কুসংস্কার সব মিলিয়ে মানুষকে সরকার ঘরবন্দী রাখতে পারছে না। নানাভাবে সংক্রামিত হয়ে পড়ছে হাজারো মানুষ। এই সংখ্যা লক্ষ লক্ষ হয়ে চরম বিপর্যয় ঘটাতে পারে।
সারা বছরের চেয়ে এই মাসেই ঠিক চরম অবস্থা বিরাজমান সময়ে এল পরম পবিত্র মর্তবার মাস রমজান। যে মাসকে বলা হয় ইসলাম ধর্মের সর্বোত্তম মাস। এই মাসেই বিশ^বাসীর উদ্দেশে নাজিল হয়েছিল পবিত্র কুরআন যাকে বলা হয় পরিপূর্ণ জীবনবিধান। আজ থেকে ৩৮৩৩ বছর আগে খ্রিষ্টপূর্ব ১৮৩৩ অব্দে মুসলিম জাতির পিতা হজরত ইব্রাহিম (আ) এর কাছে পবিত্র রমজানের ৬ তারিখে ওহি নাজিল হয়েছিল। হজরত মুসা (আ) এর ওপর ওহি নাজিল হয়েছিল ষষ্ঠ রোজার পর যা পরবর্তীতে তাওরাতে সংকলিত হয়। হাদিস শরিফে বিশেষত মসনদ শরিফের ১৬৫৩৬ নম্বর হাদিসে এ প্রসঙ্গে উলেখ আছে । পবিত্র কুরআনের সুরা তাহা’র ৯ থেকে ১৪ নম্বর আয়াতে এর উলেখ রয়েছে। ৬২৫ খ্রিষ্টাব্দে রমজান মাসেই খন্দকের যুদ্ধে মুসলমানদের রক্ষা করেছিলেন আলাহ রাব্বুল আলামিন।
দার্শনিক রাষ্ট্রবিজ্ঞানী ইতিহাসবেত্তা জ্ঞান বিজ্ঞানের এক মহিরুহ ইবনে খালদুনের জন্ম ও মৃত্যু এই রমজান মাসে। বড়পির দস্তগির হজরত আব্দুল কাদির জিলানি পবিত্র রমজান মাসে জন্মগ্রহন করেন। এমনি আছে আরো বহু নিদর্শন, কিন্তু সবকিছু ছাপিয়ে যে বিষয়টি সর্বাগ্রে উঠে আসে সেটি হলো এই মাসের ২৬ রমজান পবিত্র লাইলাতুল কদরের রাতে ইসলাম ধর্মের প্রবর্তক মহানবী হজরত মোহাম্মদ (স) এর ওপর নাজিল হয় আসমানি মহাগ্রন্থ কুরআন। তাই এই রমজান মাসের তাৎপর্য এই কারণে উঠে এসেছে সর্বোচ্চ উচ্চতায়, এই মাসের বিশেষত্ব অপরিসীম।
কিন্তু করোনা কবলিত এবারের রমজানে মানুষের মনে ভয় ও আক্ষেপ দানা বেঁধেছে। প্রতিদিন বেড়ে চলেছে মৃত্যুর হার সেই সাথে সংক্রমন বাড়ছে জ্যামিতিক হারে। ইতোমধ্যে সাংবাদিক, চিকিৎসক, স্বাস্থ্যকর্মী, এমপিসহ বিভিন্ন জন আক্রান্ত হচ্ছেন, মৃত্যুবরণও করছেন। ঝুঁকির পর ঝুঁকি বেড়েই চলেছে। ভয় তো স্বাভাবিক। আর আক্ষেপ মসজিদে গিয়ে খতম তারাবি আদায় করতে না পারার আক্ষেপ। আসলে সকল রমজানেই মসজিদে খতম তারাবি আদায় করা রমজান মাসের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বলে বিবেচিত। লম্বা নামাজ ইমামের পেছনে দীর্ঘ সময় দাড়িয়ে আদায় করার মাঝেও এক অন্যরকম সার্থকতা। আর তৃপ্তি ও অনন্য সওয়াব হাসিলের বিষয়টি হলো তারাবিহর নামাজের সাথে সাথে ২৬ তারিখ রাতেই খতম হয়ে যায় পবিত্র কুরআন পাঠ। এই ধারাবাহিকতায় ৩০ দিনের সিয়াম সাধনার পর আসে ঈদুল ফিতর। মুসলিম ইতিহাসে সবচেয়ে বড় উৎসবের দিন। তিরিশটি দিনের সিয়াম সাধনার পর ঈদুল ফিতর! একজন রোজাদারের জন্য এক মহা শান্তির দিন। কিন্তু করোনা ভাইরাসের কারণে এবার সবই পানসে। সম্ভবত এবার ঈদের জামাতও অনুষ্ঠিত হবে না দুরত্ব বজায় রাখার বৈজ্ঞানিক থিওরি নিয়ে। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে সব নামাজই না হয় ঘরে আদায় সম্ভব কিন্তু ঈদের জামাত? আসলে ঈদের জামাত অনুষ্ঠিত হতে হয় মাঠে ঈদগাহে। কিন্তু ক্রমে মাঠ ঈদগাহ সংকুচিত হওয়ায় অগত্যা মানুষ বাধ্য হয়ে মসজিদেই বেশিরভাগ ঈদের নামাজ পড়ে নেয়। এবার করোনার প্রভাবে ঈদের জামাত মাঠে পড়ার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করা হয়েছে।
এদিকে ঈদের আগে কিছু দোকানপাঠ খুলে দেয়ার সিদ্ধান্ত আসছে বলে জানা গেছে। প্রশ্ন হচ্ছে, এই করোনাকালে ঈদ কি এতোই জরুরি? জীবন যেখানে থমকে যাবার আশঙ্কা সেখানে একটি ঈদের কেনাকাটা না করলে কি জীবন শেষ হয়ে যাবে? সামাজিক দুরত্ব অবলম্বনের আসল থিওরি কি দোকানপাট খুলে দিলে ভেস্তে যাবে না? ঈদের মূল সুরটিই তো পরস্পরের কোলাকুলি। আর করোনার আসল থিওরি হলো এই কাজ করা যাবে না। কোনটি এখন গ্রহণযোগ্য? নিজেকে জিজ্ঞেস করলেই তো স্পষ্ট বিষয়টি বোঝা যায়। কেন মূর্খের মতো আমরা সিদ্ধান্ত নেব? আমরা সারাজীবনই তো ঈদ করেছি, একটা ঈদের বাইরের সামাজিকতা না করে যদি স্রষ্টার অনুকম্পা পাবার দোয়ায় আত্মনিয়োগ করি আর ঈদের ধামাক্কা খরচের মহাপসরা অভুক্ত ও বেকার হয়ে যাওয়া দিনমজুরদের মধ্যে বিলিয়ে দেই তাহলে কি ঈপ্সিত ফল আমরা পাব না? এই আপ্তবাক্যটি বুঝতে কেন আমরা এখনো বিলম্ব করছি? সরকার তো মানুষের জীবন জীবিকার প্রশ্নে বিব্রত হয়ে কিছু দোকানপাঠ খুলে দিতে চাচ্ছে। এক ঈদে গোশত পোলাও না খেয়ে লবণভাত খেলে এবং ঘরে থাকলে কি ঈদের সওয়াব নষ্ট হয়ে যাবে? জীবন বাঁচানোর প্রশ্নে বিজ্ঞানভিত্তিক ধর্ম ইসলাম কি তা সমর্থন করবে না?
বাংলাভিশনে দেখলাম এক প্রসূতি ভ্যান গাড়িতেই সন্তান প্রসব করতে বাধ্য হলো। তার স্বামী স্ত্রীকে নিয়ে ছুটে যান এক হাসপাতাল থেকে আরেক হাসপাতালে। করোনা রোগীর ভয়ে কোনখানেই ভর্তি করতে পারেননি। হাসপাতালে গিয়ে দেখা যায় ডাক্তার নেই। সবাই ভেবেছে সর্বনাশ হয়তো করোনা রোগী। কিন্তু করোনা রোগী হওয়া কি পাপ? করোনার জন্য কি রোগী দায়ী? এই মহিলা তো ছিল প্রসুতি রোগী। কিন্তু তাকে ঢুকতেই দেয়া হলো না। বলা হলো, গাইনি তো তিন তালায়। তোলা যাবে না ইত্যাদি। নানা খোঁড়া অজুহাত। প্রসূতিকে নিয়েতখন কথাবার্তা বলার সময় ছিল না। রাস্তার ওপরে একটু কাপড় দিয়ে আড়াল করে রাস্তার উপরেই প্রসূতি সন্তান প্রসব করলো। সবাই এই দুরবস্থা দেখল, কিন্তু কেউ কিছু বললো না। করোনার জন্য আমরা কি এতটাই নিচে নেমে গেছি? আমাদের মানবতাও শেষ? কী হৃদয়বিদারক! প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে অন্যন্য রোগীর জন্য অবিলম্বে খোলার ব্যবস্থা করা দরকার। সময়মতো সেখানে চিকিৎসকরা ডায়াবেটিস, রক্তচাপ, হৃদরোগ, কিডনি, ক্যানসার, আলসার ইত্যাদি জটিল রোগীরা করোনাকালে যাবে কোথায়? তাদের ব্যাপারে কারো কোন দৃষ্টিও নেই। অবিলম্বে এই ব্যাপারে ব্যবস্থা গ্রহন করা অপরিহার্য্য। না হলে করোনা ছাড়াও এইসব জটিল রোগে মানুষের জীবন অবসান চলতেই থাকবে। ঈদের শপিংমল খোলার চাইতে অন্যান্য প্রাইভেট হাসপাতালগুলোকে স্বাভাবিকভাবে চালানোর ব্যবস্থা এখনি করা দরকার।
করোনা নিয়ে মন্তব্য গবেষণা আলোচনা-পর্যালোচনার শেষ নেই। কেউ বলছেন করোনা বাংলাদেশে তেমন সুবিধা করতে পারবে না। তার কারণ এখানকার মানুষ আসলেই জীবাণুর মধ্যে বাস করে। এতে তাদের দেহাভ্যন্তরে ইমিউনিটি শক্তি বেশি। তাছাড়া প্রাকৃতিক উষ্ণতাও এদেশে গণমানুষের জন্য সহায়ক। একবার এক বিদেশি সাংবাদিক কমলাপুরে রাত বারোটায় এতো ছিন্নমুল লোকের প্রচন্ড শীতে মানবেতরভাবে শুয়ে থাকা ও মারাত্মক অস্বাস্থ্যকর খাবার গ্রহণের অবস্থা দেখে বলেছিলেন,
‘সর্বনাশ এভাবে কি করে মানুষ বাঁচে? আমাদের দেশ হলে তো সব মরে ভূত হয়ে যেত! আসলে আমি দেখলাম স্রষ্টা সম্ভবত বাংলাদেশেই থাকেন, নয়তো এই দুরবস্থার মধ্যে মানুষ তো ঠিকই হাসিমুখে বেঁচে আছে মাসের পর মাস বছরের পর বছর। এই যে ছোট শিশুরা এতো রাতে রেললাইনে পড়ে থাকা মাছি ভনভন করা উচ্ছিষ্ট খাবার তুলে দিব্যি খাচ্ছে, এটা নিশ্চই স্রষ্টার বিশেষ অনুকম্পা! সবচেয়ে বড় কথা, এটাতো একদিনের আকস্মিক দৃশ্য নয়, এই দৃশ্য নিত্যদিনের।’
আসলে হয়তো ঠিকই বলেছিলেন সেই বিদেশি সাংবাদিক।
আবার কেউ বলছেন বাংলাদেশে মাত্র তো শুরু। সংক্রমন বেড়ে চলছে, সরকারি নির্দেশনা না মেনে। এর খেসারত কিন্তু দিতেই হবে বাংলাদেশকে। মে মাসের শেষের দিকেই তা টের পাওয়া যাবে। ২৯ এপ্রিল ফিনান্সিয়াল টাইমসের বরাত দিয়ে জাতীয় দৈনিক যুগান্তর লিখেছে বিশ^ জুড়ে করোনায় মৃত্যু হিসাবের চেয়েও ৬০ গুণ বেশি!
বলা হয়েছে, যে হিসাব দেয়া হয়েছে তা থেকেও পরিস্থিতি ভয়ংকর। সে যাই হোক করোনার ভয়াবহতা এখন সকল প্রশ্নের ঊর্ধ্বে এটা সবাইকে মেনে নিতে হবে। সামাজিক দূরত্ব বজায় না রেখে বিধি মোতাবেক ঘরবন্দি না থাকলে সংক্রমণ থেকে রেহাই নেই। আগে সচেতনতার মাধ্যমে সংক্রমণ রোধ করতেই হবে। কিন্তু শুধু স্কুল-কলেজ ও মসজিদের সংক্রমণ রোধ করলেই কি সব সমস্যার শেষ হবে? হাট-বাজার পরিবহন হোটেল-রেস্টুরেন্ট গার্মেন্টস থেকে কি করোনা সংক্রামিত হবে না? সবই তো খোলা বা খুলছে। কিন্তু সব ছাপিয়ে করোনা কেন ঢুকবে স্কুল কলেজ মসজিদে? এখানে তাহলে নিষেধাজ্ঞার কোনো দরকার নেই? আসলে বাংলাদেশে কার্যত এখন লকডাউন নেই। সিঙ্গাপুরের এক বিশ^বিদ্যালয়ের গবেষণা থেকে জানা গেছে, বাংলাদেশে মে মাসের পর করোনা থাকবে না। এটার ওপর নির্ভর করা টিক হবে না। সরকার হয়তো মানুষের জীবন-জীবিকার দিকে চেয়ে এটা করেছে, কিন্তু সার্বিক অবস্থা দৃষ্টে মনে হয় সরকার জুন মাসটা পর্যন্ত অপেক্ষা করলে ভালো হতো। প্রলম্বিত হওয়ায় সাধারণ মানুষের নাভিশ^াস উঠবে এটা ঠিক কিন্তু তাতে পরিস্থিতির উন্নতি হতো এ কথা বলা যেত। বৃহত্তর স্বার্থের খতিরে এটা করাই মনে হয় ভালো হতো। বিশেষজ্ঞদের পরামর্শক্রমে সরকার বিচার বিশ্লেষণ করে ব্যবস্থাগ্রহণ করবেন এটাই কাম্য।
জার্মানি তাদের দেশে লকডাউন তুলে দিয়ে পড়েছে নতুন করে বিপদে। তাদের দেশে এখন নতুন করে অত্যন্ত দ্রত বেড়ে গেছে সংক্রমণ। বাংলাদেশে লকডাউন থাকলেও বিভিন্ন সেক্টরে তারা ঢিলে হয়ে পড়েছে, এ অবস্থায় পরিস্থিতি যে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায় তা বলে দেবে সময়। এই বিষয়টি সরকারের সংশ্লিষ্ট দায়িত্বপ্রাপ্ত বিভাগ পুনর্বিবেচনা করবেন এই আশা করি।
লেখক : সাংবাদিক ও প্রাবন্ধিক।
-তথ্যসূত্র: জাতীয় সাপ্তাহিক পূবের হাওয়া