অনিয়ম দুর্নীতি : কুলাউড়ায় অপরিকল্পিত নদী খনন,রাস্তাঘাট ঘরবাড়ি মসজিদ ক্ষতিগ্রস্থ

পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৬:৪৩ অপরাহ্ণ
নাজমুল ইসলাম,কুলাউড়া
কুলাউড়ায় ফানাই নদী খনন কাজে ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতির অভিযোগ উঠেছে। নদী খননে অনিয়ম হচ্ছে এমন দাবী করেছেন নদী তীরবর্তী এলাকার মানুষ। কাজের দায়িত্বে নিয়োজিত ঠিকাদারী প্রতিষ্ঠানের লোকজনের স্বেচ্ছাচারিতা অনৈতিক ফায়দা হাসিলে অপচেষ্টার কারনে ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে শতাধিক ঘরবাড়ি রাস্তাঘাট। রক্ষা পাচ্ছে না মসজিদ-কবরস্থান ও মন্দির।
কুলাউড়া উপজেলার কর্মধা ইউনিয়নের পূর্ব কালা পাহাড় থেকে উৎপত্তি হয়ে এশিয়ার বৃহত্তম হাকালুকি হাওরে গিয়ে মিলিত হয়েছে এ ফানাই নদী। পাহাড়ে উৎপত্তিস্থল হওয়ায় বর্ষা মৌসুমে নদীর পানির গতিপ্রবাহ বেশি। ফলে বর্ষা মৌসুমে প্রায় প্রতি বছর নদীর পানি উপচে দু’তীরের ফসল ও বাড়িঘরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত করে। তাই পানি উন্নয়ন বোর্ড ২০১৯ সালে নদীর খননসহ প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণে প্রকল্প গ্রহণ করে।
পানি উন্নয়ন বোর্ড সুত্রে জানা যায়, উপজেলার মধ্যে বয়ে যাওয়া ৪০ কিলোমিটার এই দীর্ঘ নদীটি খননকাজ ও প্রতিরক্ষা বাঁধ নির্মাণ প্রকল্প শুরু করে। এই প্রকল্পের ব্যয় ধরা হয় ১৭ কোটি টাকা। হাকালুকি হাওর থেকে শুরু করে নদীটি উপজেলার ভুকশিমইল, কাদিপুর, ব্রাহ্মণবাজার, রাউৎগাঁও, কুলাউড়া সদর ও কর্মধা ইউনিয়ন দিয়ে খনন কাজ পূর্ব কালা পাহাড় মহিষমারা এলাকায় গিয়ে শেষ হবে।
সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, ইতোমধ্যে নদীর খনন কাজ ৪ ভাগের ৩ ভাগ সম্পন্ন হয়েছে। বড় বড় ইউটার্ন রেখে নদী খনন করা হচ্ছে। যা বর্ষা মৌসুমের শুরুতে পানির স্রোতে ভেঙ্গে যাবে। ফলে বর্ষা মৌসুমে নদী ভাঙ্গন দেখা দেবে। তাছাড়া কাজ শেষ করার ৩-৪ দিনের মাথায় নদীর প্রতিরক্ষা বাঁধ নদীগর্ভে ধ্বসে পড়ছে। অপরিকল্পিত খননে রাউৎগাঁও, কুলাউড়া সদর ও কর্মধা ইউনিয়নের কমপক্ষে ৮টি ব্রীজ ঝুঁকির মুখে রয়েছে।
রাউৎগাঁও ইউনিয়নে খনন কাজে নিয়োজিত মাটির কাটার এসকেভেটর চালকরা জড়িয়ে পড়েন নানা অনৈতিক অপকর্মে। নদী খনন করতে গিয়ে রাউৎগাঁও ইউনিয়নের চৌধুরী বাজার মুকুন্দপুর রাস্তার মরহুম হাজী ছলিম মিয়ার বাড়ীর সম্মূখ হতে ফানাই নদীর ব্রীজ পর্যন্ত রাস্তা কেটে চলাচলের পথ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে। ফলে গত দেড় মাস থেকে চৌধুরী বাজারে সাথে এই আঞ্চলের মানুষের যোগাযোগ বিছিন্ন রয়েছে। ইতিমধ্যে স্থানীয় এলাকাবাসী রাস্তাটি রক্ষা করে নদী খননের কাজ করার জন্য উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোডের নির্বাহী প্রকৌশলী বরাবরে লিখিত আবেদন দিয়েছেন। এছাড়াও প্রকল্প কাজের ঠিকাদার ও সাইট ঠিকাদারকে বিষয়টি বলার পরও কোন প্রদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি।
কর্মধা ইউনিয়নের হাসিমপুর-রাঙ্গিছড়া রাস্তা এবং হাসিমপুর কবিরাজি ইটসোলিং রাস্তাটিও কেটে সরানো হচ্ছে। ফলে এই দু’টি রাস্তা দিয়ে চলাচলকারী মানুষ চরম দুর্ভোগের শিকার হতে হবে। তাছাড়া এই রাস্তা দিয়ে যাতায়াতকারী সিএনজি অটোরিক্সা সহ বিভিন্ন যানবাহন চলাচল বন্ধ হয়ে গেছে। ইতোমধ্যে দু’টি প্রধান সড়ক সহ ৫ টি সংযোগ সড়ক বন্ধ করা হয়েছে। নদী খননের ফলে মুকুন্দপুর কোরআন শিক্ষাকেন্দ্র (স্থানীয়দের ভাষায় মক্তব) পূর্ব হাসিমপুর মসজিদ, পূর্ব হাসিমপুর কবরস্থান এবং পূর্ব কবিরাজি কালি মন্দির ক্ষতির সম্মুখীন হয়েছে।
রাউৎগাঁও ইউপি সদস্য মো. আনু মিয়া জানান, নদী খননের ফলে ইউনিয়নের বাগাজুরা, মুকুন্দপুর, গুতগুতি, কবিরাজি, লক্ষীপুর গ্রামের শতাধিক পরিবার জমি হারিয়ে ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।
এছাড়া কমপক্ষে ১৫-২০টি পরিবার সম্পূর্ণভাবে বাড়িঘর হারিয়েছে। কবিরাজী গ্রামের রেজিয়া বেগম, হাসিমপুর গ্রামের আনোয়ারা বেগম,ছানা বেগম, জুনাব আলী, নেওয়া বেগম, মুকুন্দপুর গ্রামের সুফিয়া বেগম, ছালেক মিয়া বলেন তাদের বসত ঘরের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়েছে তাঁরা বাপ-দাদার আমল থেকে এখানে বসবাস করে আসছেন। কিন্তু তাদের কোন ব্যবস্থা না করে অপরিকল্পিতভাবে খনন কাজ শুরু করায় ভিটামাটি সব চলে গেছে নদীগর্ভে। এখন আমরা কোথায় যাবো। মাথাগুজার কোন ঠাঁই নেই। গুতগুতি গ্রামের শহীদ মিয়া বলেন, আমার ঘর খনন কাজে কাঁটা পড়বে না বলে আমার কাছ থেকে সাত হাজার নিয়েছে মাটি কাঁটার গাড়ী চালক।
হাসিমপুর গ্রামের কনই বেগম বলেন, ৫ সন্তান নিয়ে এই কনকনে শীতের মধ্যে ভাঙ্গা ঘরে রাত পোহাচ্ছি। নদীর মাঠি আমার ঘর বন্দি করে রেখেছে।
এছাড়াও এলাকাবাসীর অভিযোগ করে বলেন, অপরিকল্পিতভাবে খনন কাজের ফলে আমাদের লাগানো গাছ, বাঁশ, সবজী ধ্বংস হয়েছে যাচ্ছে। নদীর খনন কাজে নিয়োজিত ব্যক্তিরা বিত্তবানদের কাছ থেকে অনৈতিক সুবিধা নিয়ে নদীর গতিপথ পরিবর্তন করছেন। ইচ্ছামতো খননকৃত মাঠি যত্রতত্র ফেলা হচ্ছে। কাজের সাথে ড্রেসিং না করায় শত শত পরিবার মাঠি বন্দী।
এ ব্যাপারে রাউৎগাঁও ইউপি চেয়ারম্যান আব্দুল জলিল জামাল বলেন, ইউনিয়নের ৫/৭ টি গ্রামের মানুষের কষ্টের কারনে দ্রুত কাজ শেষ করার জন্য সংশ্লিষ্ট ঠিকাদারকে তাগিদ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে রাস্তা, মসজিদ, কবরস্থান রক্ষাসহ বিভিন্ন দাবী নিয়ে উপজেলা নির্বাহী নির্বাহী কর্মকর্তা ও পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলীর কাছে লিখিত আবেদন করা হলে গত ২৭ জানুয়ারী পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী প্রকৌশলী, কুলাউড়া উপজেলা চেয়ারম্যান ও উপজেলা নির্বাহী অফিসার এলাকা পরিদর্শণ করেন। কিন্তু তাতে কোন সুফল পাওয়া যায়নি।
এব্যাপারে মৌলভীবাজার পানি উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালক আক্তারুজ্জামান জানান, কুলাউড়া উপজেলার ৭টি ইউনিয়নের মধ্য দিয়ে প্রবাহিত এই নদীটির খনন কাজ আমি সরেজমিন পরিদর্শণ করেছি। কাজের কোথায়ও কোন অনিয়ম হচ্ছে না। নদীর লোপ কাটিংয়ের কোন সুয়োগ নেই। নদীর ভেতরে যাদের বাড়ি ঘর পড়েছে, তারা স্বেচ্ছায় সরে যাচ্ছে। তাছাড়া যারা দীর্ঘদিন থেকে নদীর পাশে জায়গা দখল করে বসবাস করছে তাদের ব্যাপারে আমাদের করার কিছু নেই। তাদের ব্যাপারে আমাদের কিছু করার নেই। আমরা কাউকে উচ্ছেদ করছি না। কেউ ভিটেমাটি হারা হয়ে গেলে সরকারের গৃহায়ণ প্রকল্পে ঘরের জন্য আবেদন করতে পারেন।