ঠাঁই হয়না পরিবারে, পাল্টে ফেলতে হয় নাম পরিচয়
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২০ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৬:৫২ অপরাহ্ণ
::: সুবর্ণা হামিদ :::
হিজড়া; সমাজে অবহেলিত একটি জনগোষ্ঠীর নাম। স্বাভাবিক পরিবেশে নিজ-নিজ পরিবারে তাদের জন্ম হলেও বেড়ে ওঠা হয় না। এমন এক কঠিন বাস্তবতায় যাদের জীবন বয়ে চলে সমাজে তারাই হিজড়া নামে আমাদের কাছে পরিচিত। অথচ তাদের জন্ম আপনার আমার মত কোন না কোন পরিবারে। শিশুকালটাও কাটে পরিবারের সাথে। কিন্তু বয়স বাড়ার সাথে সাথে তারা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যায়। যুক্ত হয় সম্পূর্ণ ভিন্ন অচেনা এবং নতুন এক পরিবারের সাথে। বাকি জীবনটা তাদের সাথে কাটাতে হয় সমাজ বাস্তবতায়। অথচ জন্ম নেওয়ার সময় তারও একটা নাম পরিচয় থাকে অন্য আট দশ জন শিশুর মতো। পরিবারের দেওয়া নামেই পরিচিত হয় একটা বয়স পর্যন্ত। কিন্তু সৃষ্টিগত ত্রুটির কারণে তৃতীয় লিঙ্গ তথা হিজড়া হয়ে জন্ম নেওয়া শিশুটি পরিণত বয়সে পা দেওয়ার আগেই বাবা-মায়ের দেয়া পারিবারিক নামটা হারাতে বসে। একটা নির্দিষ্ট সময়ের পরে নামটা একেবারেই হারিয়ে যায়। সম্পূর্ণ নতুন পরিচয়ে বেড়ে ওঠতে হয় তাদের।
হিজড়াদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, নির্দিষ্ট একটি বয়স পর্যন্ত তাদের সবকিছু ঠিকঠাক মতো আগালেও যখন থেকে তাদের মধ্যে পরিবর্তন আসা শুরু করে তখনি অন্ধকার নেমে আসে তাদের জীবনে। শরীর পরিবর্তনের সাথে সাথে যেনো বদলে যায় তাদের পৃথিবী। জন্মদাতা মা-বাবা থেকে শুরু করে সবকিছুই যেনো তাদের কাছে অচেনা হয়ে যায়। আর তখন থেকেই পাল্টে যায় তাদের পরিচয়, বদলে যায় নাম পর্যন্তও। শুরু হয় নতুন জীবন সংগ্রাম। নিজের পরিবার পরিজন ছেড়ে তাদের চলে যেতে হয় ভিন্ন পরিবেশে অন্য পরিবারে। যেখানে পরিচিত হতে হয় সম্পূর্ন নতুন পরিচয়ে। হিজড়া হিসেবে নিজেকে আবিস্কার করার পরে আগের মানুষটার সঙ্গে তাদের আগের নামটাও বিলীন হয়ে যায়। এই যেমন নিজাম উদ্দিন হয়ে গেছেন নাজমা হিজড়া, কিংবা আখি বেগম হয়ে গেছেন আক্তার হিজড়া। এভাবে নতুন করে নতুন নামে নতুন পরিচয়ে হিজড়া সমাজে বেড়ে উঠতে হয় তাদের।
হিজড়াদের সাথে কথা বলে জানা গেছে তাদের প্রথম জীবনযুদ্ধ শুরু হয় পরিবার থেকে। এরপর তাদের সামনে বাধার দেয়াল হয়ে দাড়ায় সমাজ। ফলে একটা সময় বাধ্য হয়ে তাদের এই দুই জায়গা থেকে বিতাড়িত হয়ে যেতে নতুন সমাজ ব্যবস্থায়। আরমান থেকে আসমা হয়ে ওঠা আসমা হিজড়া ছোটবেলায় নিজের পরিবর্তনের সময়কার অভিজ্ঞতা বর্ণনা করতে গিয়ে বলেন, এক সময় আমি ছেলে ছিলাম। ছেলেদের সাথে লেখাপড়া ও খেলাধূলা করতাম। কিন্তু একটা সময় যখন আমার বয়স ১৪ পেরিয়ে গেলো তখন থেকে পরিবর্তন শুরু হলো। অনেকটা মেয়েদের মতো কন্ঠ হয়ে গলো। চলাফেরা ও করতাম মেয়েদের মতো। ছেলে সঙ্গ ত্যাগ করে তাদের সাথে খেলাধূলা ও স্কুলে যেতে শুরু করলাম। এটাকে কেউ ভালো চোখে দেখতো না। শুরু হলো আমাকে নিয়ে নানা কথা। এক পর্যায়ে বিতাড়িত হলাম পরিবার থেকে। পা বাড়ালাম অনিশ্চিত এক জীবনের পথে। যে পথের শুরুতেই বদলে গেলো অনেক কিছু। জন্ম মাটি থেকে শুরু করে মা-বাবা, ভাই-বোন কিংবা আতœীয়-স্বজনের মতো ধীরে ধীরে আমার আগের নামটিও কালের গর্বে হারিয়ে গেলো। আরমান থেকে গেলাম আসমা। শুরু হলো এক নতুন জীবন সংগ্রাম।
মানবাধিকার বিশেষজ্ঞ রাবেয়া রওশন বলেন, নানা ভাবে অবহেলিত ও বঞ্চিত একটি জনগোষ্ঠী হলো হিজড়া জনগোষ্ঠী। যাদের অবহেলা ও বঞ্চণার শেষ নেই। সরকার হিজড়াদের ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে। ফলে তাদের সাংবিধানিক অধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। এখন নতুন আদম শুমারীতে তাদের কে তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবেই অন্তর্ভুক্ত করা হবে। এটা একটা বড় অর্জন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আগামীতে এরকম ভাবে তাদের প্রতি করা অন্যান্য বৈষম্যগুলো দূর করতে হবে। পরিবার থেকে বিতাড়িত হওয়ার পাশাপাশি এক সময় বদলে ফেলতে হয় তাদের নামও। এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। যাতে করে বঞ্চিত ও অবহেলিত এই জনগোষ্ঠীকে সমাজের মুলধারার জনগোষ্ঠীর অনাদর আর অবহেলার শৃংখল থেকে বের করে আনা যায়।
শাহজালাল বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ^বিদ্যালয়ের কাউন্সেলিং সাইকোলজিস্ট ফজিলাতুন নেসা শাপলা বলেন, রক্ষণশীল এবং নেতিবাচক মনোভাবের কারণে বিশেষ করে বাংলাদেশের হিজড়াদের অবস্থা খুবই করুণ। এমন কি সামাজিক কুসংষ্কার এবং সচেতনতা ও সঠিক জ্ঞানের অভাবে একটি পরিবাওে সন্তান যদি হিজড়া হয় তাহলে তাকে পরিবার থেকে গ্রহণ করা হয়না। সেই হিজড়া শিশুটিকে যদি বেঁচে থাকতে হয় তাহলে তাকে পাল্টে ফেলতে হয় তার পারিবারিক পরিচয়। পরিবার বেশিরভাগ ক্ষেত্রে স্বীকারই করতে চায়না তাদের এমন সন্তানদের। একজন হিজড়াকে বেড়ে উঠতে হয় শারীরিক,মানসিক হ্যারাসমেন্টের মধ্য দিয়ে। তাদের প্রতিনিয়ত শিকার হতে হয় বাচিক ও অবাচিক নির্যাতনের । দুঃখজনক হলেও সত্যি যে হিজড়া শব্দটা এসেছে একটি ফার্সি শব্দ থেকে। এর মানে হলো সম্মানিত ব্যাক্তি। অথচ এদের নেই কোন সামাজিক মর্যাদা।