সমাজে বোঝা নয়, মর্যাদা নিয়ে বাঁচতে চায় তারা
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২৫ ফেব্রুয়ারি ২০২১, ৩:৫০ পূর্বাহ্ণ<><> সুবর্ণা হামিদ <><>
তানিসা ইয়াসমিন চৈতি ; হিজড়া সমাজের একটি সংগ্রামী নাম। যে নামের সাথে জড়িত রয়েছে দু:খ, কষ্ট, হাসি ও সম্ভাবনার গল্প। রয়েছে চোখে আঙ্গুল দিয়ে দেখিয়ে দেওয়া আমাদের ভঙ্গুর সমাজের চিত্র। যিনি তার কর্মের মাধ্যমে ফুটিয়ে তুলেছেন সমাজের স্বার্থপর গল্প। হিজড়া সন্তান ও যে পরিবার ও সমাজের বোঝা না হয়ে সম্পদে পরিণত হতে পারে, হয়েছেন তার দৃষ্টান্ত।
চৈতির মতো এখন অনেক হিজড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে চাকরি করছেন, কেউবা পরিচালনা করছেন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান, আবার কেউবা নিজেকে গড়ে তুলেছেন উদ্যোক্তা হিসেবে। নিজে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার পাশাপাশি হাল ধরছেন বঞ্চিত হওয়ার পরিবারের। যে পরিবার এক সময় হিজড়া হিসেবে দুরে ঠেলে দিয়েছিলো তারাই যখন প্রতিষ্ঠিত হয়েছেন তখন সাদরে গ্রহণ করেছেন। হিজড়াদের অবহেলা ও বঞ্চণার গল্পে এগুলো এখন আশার আলো। তাইতো এখন হিজড়াদের কন্ঠে বহুল উচ্চারিত শব্দটি হচ্ছে বোঝা নয়, সম্পদ হতে চাই। সমাজে মানুষের মতো মানুষ হিসেবে বাঁচতে চাই।
আবারও ফিরছি তানিসা ইয়াসমিন চৈতি’র জীবন সংগ্রামের গল্পে। পেশায় একজন বিউটিশিয়ান। লেখাপড়া করেছেন ডিগ্রি পর্যন্ত। হিজড়া কমিউনিটির একজন অগ্রসর সদস্য হলেও নিজেকে রুপান্তরিত নারী হিসেবে পরিচিত করতে স্বাচ্চন্দ্যবোধ করেন। হিজড়া কে কালচার হিসেবে উল্লেখ করে তিনি তার কষ্টের কথাগুলো তুলে ধরেন- রাজবাড়িতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা চৈতি। অন্য আট দশজনের মতো জন্মের পরের এক যুগ কেটেছে পরিবার পরিজনদের সাথে সুখে স্বাচ্ছন্দ্যে।
জন্ম হয়েছিলো ছেলে হিসেবে । কিন্তু এক সময় আমার শারিরিক পরিবর্তন শুরু হলে আমি মেয়েদের মতো রপান্তরিত হতে শুরু করি। এরপর থেকে কেউ আমাকে আর ভালো চোখে দেখতো না। এমনকি নিজ পরিবার থেকেও একসময় বিতাড়িত হতে হয়েছে। ফ্যামিলি সাপোর্ট একেবারে পাইনি। যে কারণে বিভিন্ন জায়গায় ঠোকর খেতে হয়েছে। যখন বয়স ১১-১২ হলো তখন থেকে শুরু হলো নতুন এক কষ্টের জীবন। যেখানে শুধু বঞ্চণা আর অবহেলা ছাড়া কিছুই মিলেনি। চৈতি বলেন, মেয়ে থেকে ছেলে হলে কোন সমস্যা ছিলো না আমাদের সমাজ বাস্তবতায়। কিন্তু ছেলে থেকে মেয়ে হওয়াটা অপরাধ। যে অপরাধের যাঁতাকলে পিষ্ট হতে হয়েছে আমাকে। মেয়েদের মতো শারিরিক গঠন হওয়ায় ভালো ভাবে দেখেনি আমাদের সমাজ। যার প্রভাব পড়ে আমার পরিবারেও। বাধ্য হয়ে এক সময় ঘর ছাড়তে বাধ্য হই আমি। তখন থেকে ফ্যামেলির সাথে টানাপোড়েন এবং হিজড়াদের সাথে উঠাবসা। ফ্যামেলি ভাবতো আমার সন্তান হিজড়া এগুলো ভয় পেতো। আমার মা হয়তো চেষ্টা করতো আমি লেখাপড়া করি। কিন্তু তা বেশি দিন ছিল না। এক সময় আমি হিজড়াদের সাথে যুক্ত হই। এরপর হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাথে যুক্ত হওয়ায় আজকে আমার এই অবস্থান তৈরি হয়েছে। এখন অনেকে আমাকে লুফে নিতে চায়।
কিন্তু এখন যে আমি বিউটিশিয়ান, কিংবা বিভিন্ন সভা ও সেমিনারে উপস্থাপনা করি এগুলো একদিনে হয়ে উঠেনি। এর পেছনে অনেক কষ্টের ও ত্যাগ-তীতিক্ষার গল্প। রয়েছে অনেক মানুষ ও সংগঠনের অবদান। তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য তৎকালীন সময়ের ঢাকা রেঞ্চের ডিআইজি হাবিবুর রহমান ও হিজড়াদের নিয়ে কাজ করা বৃহৎ সংগঠন ‘বন্ধ’। যাদের অবদান কোন দিনও ভুলার নয়। আজকের চৈতি হওয়ার পেছনে মুখ্য ভুমিকা পালন করেছেন তারা। যে কারণে অনেক প্রতিকুলতা অতিক্রম করে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করতে পেরেছি। আয় রোজগার করছি ফলে এখন ফ্যামেলিও আমাকে সাপোর্ট করে। সমাজের অন্যান্য সদস্যের মতো এখন আমাকে দেখে। তার মতে সমাজে বোঝা না হয়ে যার যার মতো যোগ্যতা অনুযায়ী হিজড়ারা যাতে কর্মক্ষম হন তাহলে সামাজিক মর্যাদা বৃদ্ধি হওয়ার পাশাপাশি পারিবারিক অবস্থানটাও তৈরি হবে। তবে এজন্য রাষ্ট্রকে এগিয়ে আসতে সর্বাগ্রে। হিজড়া জনগোষ্টীকে স্বীকৃতি দিয়েছি ঠিকই। কিন্তু এই বিষয়ে এখন পর্যন্ত সু-স্পষ্ট কোন ঘোষণা নেই। আমাদের সমাজে এখনো অনেক বৈষম্য। নারী পুরুষের আলাদা সুযোগ-সুবিধা রয়েছে।
রাষ্ট্রের কাছে দাবি করেন, ২০১৩ সালে হিজড়াদের তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে সরকার স্বীকৃতি দিয়েছে। এই ঘোষনার পরিপ্রেক্ষিতে কিছু পলিসি বা ল তৈরি করতে হবে। সে বিয়ে করতে পারবে, সংসার করতে পারবে কিনা, পরিবার থেকে কতটুকু সম্পত্তি পাবে, রাষ্ট্র থেকে কি কি সুবিধা পাবে। চাকুরী করতে পারবে। এগুলো নিয়ে কাজ করতে হবে। তিনি গত নির্বাচনে ১২ জন হিজড়া সংরক্ষিত মহিলা আসনের জন্য মনোনয়র কিনেছেন উল্লেখ করে বলেন, তারা ফরম পূরণ করতে গিয়ে সেটা করতে পারেননি। কারণ সেখানে হিজড়াদের জন্য আলাদা কোন অপশন ছিলো না। এই জায়গায় কাজ করতে হবে। আইনগুলো সুনির্দিষ্টভাবে প্রণয়ন করতে হবে। যাতে একজন হিজড়া তার পরিচিতি দিয়ে এই কাজগুলো করতে পারে। এছাড়া সমাজের মানুষে যেনো আড়চোখে না দেখে আমাদেরকে মানুষ হিসেবে দেখে এটাও প্রত্যাশা করেন তিনি।
চৈতির মতো সিলেটের হিজড়া সমাজে প্রতিষ্ঠিত একটি নাম সুপ্তা হিজড়া। যিনি হিজড়াদের নিয়ে কাজ করে থানে। বিভিন্ন সভা-সেমিনারে বেশ সাবলীলভাবে তুলে ধরেন তাদের সমস্যা ও সম্ভাবনার কথা। তিনি বলেন, আমাকে যে কোন কাজ দেন আমি তা করতে পারবো। কিন্তু কাজ না দিলে আমি কি করবো। ভিক্ষাবৃক্তি কিংবা চল্লা তুলে (বিভিন্ন ভাবে চাঁদা তুলা) আমার পেট চালাতে হবে। ট্রাফিকে মতো কঠিন চাকুরী দিলেও আমি করতে পারবো উল্লেখ করে তিনি বলেন, সরকারি যে কোন কাজে আমাদের যুক্ত করলে আমরা তা ভালো ভাবেই করতে পারবো। যোগ্যতা অনুযায়ী যদি সরকার আমাদের কাজে লাগাতো তাহলে আমাদের জীবনে এত কষ্ট আর দুর্দশা থাকতো না। আমরা ও পেটের দায়ে নিন্দিত কাজে লিপ্ত হতাম না। সবাই চায় এই সমাজে মর্যাদার সাথে বেঁচে থাকতে। দেশ ও রাষ্ট্রের বোঝা না হয়ে জীবন-যাপন করতে।
সিলেটে হিজড়াদের গুরুমা হিসেবে দীর্ঘ দিন থেকে কাজ করছেন সুন্দরী হিজড়া। তার অধীনে প্রায় ৫ শতাধিক হিজড়া রয়েছেন। কিন্তু তাদের বেশিরভাগই মানবেতর জীবনযাপন করছেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, ধর্ম, বর্ণ, লিঙ্গ, বাসস্থান বা পেশাগত কারণে কোনো নাগরিকের প্রতি বৈষম্য করা যাবে না। কিন্তু আমাদের দেশে আমরা চরম অবহেলার শিকার হিজড়া হিসেবে। রাষ্ট্র তৃতীয় লিঙ্গ হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছে ঠিক, কিন্তু তাতে সমাজে কোনো পরিবর্তন আসেনি। যে কারণে এই স্বীকৃতি আমাদের কোন কাজে আসছে না। তিনি সামাজিক দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তনের পাশাপাশি হিজড়াদের জীবন মান উন্নয়নে প্রকৃত উদ্যোগ গ্রহণের জন্য সরকারের প্রতি আহবান জানান। নতুন সরকারের স্বীকৃতি কাগজেই সীমাবদ্ধ থাকবে এবং হিজড়া জনগোষ্ঠীর অবহেলা কিংবা বঞ্চণার কোন সুরাহা হবে না।