স্মৃতিচারণ: অমর অঞ্জলি
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ৩১ মার্চ ২০২১, ১:৫৪ পূর্বাহ্ণ
:: শামীমা ইয়াসমীন (অনিন্দ্য ঈপ্সিতা) ::
‘স্কলার্সহোম’-এ চাকরির জন্য লিখিত ও মৌখিক পরীক্ষার দিন স্যারের সাথে প্রথম সাক্ষাত। পরীক্ষার হলে প্রবেশ করলেন একজন সুদৃঢ়, অমায়িক, ন্যায়নিষ্ঠাবান প্রাণের প্রতীক। হ্যাঁ, স্কলার্সহোমের প্রতিষ্ঠাতা অধ্যক্ষ ও একজন স্বপ্নদ্রষ্টা নাবিক ব্রিগ্রেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকীর কথা বলছি। উপস্থিত পরীক্ষার্থীদের দিক নির্দেশনা দিলেন- ‘দুর্নীতি দমন’ বিষয়ে প্রবন্ধ লেখার জন্য। সময় সম্পর্কে বার বার সর্তক সংকেত দিয়ে চলে গেলেন। লিখিত পরীক্ষা শেষ হওয়ার পর ফলাফল ঘোষণার জন্য অপেক্ষার পালা শেষ হলে মৌখিক পরীক্ষার জন্য নির্বাচিত হলাম। যথারীতি মৌখিক পরীক্ষায় মুখোমুখি হলাম প্রিন্সিপাল জুবায়ের সিদ্দিকী এবং স্কলার্সহোমের একাডেমিক কাউন্সিলর কবির স্যারের সাথে। বিভিন্ন প্রশ্নের উত্তর দেয়ার মাঝে আমার মস্তিষ্ক ও চেতনাজুড়ে প্রিন্সিপাল স্যারের মুখে আমার জন্মদাতা ও প্রথম প্রেমময় প্রিয়জন বাবার মুখটি বার বার ভেসে উঠছিল। মনে হচ্ছিল, বাবা প্রশ্ন করছেন আর আমি উত্তর দিচ্ছি। ঠিক আমার ছাত্র জীবনে পরীক্ষার পূর্বে বাবার কাছে পড়া দেয়ার মতো। হঠাৎ কবির স্যার আবৃত্তি ও গানের প্রসঙ্গ তুললেন। গান গাইতে বললেন। কীভাবে দু’লাইন রবীন্দ্র সংগীত গেয়েছিলাম মনে করতে পারছিনা। শুধু তাকিয়ে তাকিয়ে বাবাকে দেখছিলাম, আর বলছিলাম: ‘ভালবাসি ভালবাসি। আজ কাছে দূরে জলে-স্থলে বাজায়, বাজায় বাঁশি, ভালবাসি ভালবাসি’।
আমার জন্মদাতা বাবা ইহলোক ত্যাগ করেছেন ২০০৩ সালে। মনে হচ্ছিল, স্বর্গলোক থেকে বাবা যেন আবির্ভূত হয়েছেন শুধুই আমার জন্য এই ধরাধামে দ্বিতীয় বারের মতো!!
এরপর শুরু হলো কলেজে বাংলার প্রভাষক হিসেবে আমার পথচলা। এর পূর্বে তিনটি মাধ্যমিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকতা করেছিলাম। নিয়মিত শৃঙ্খলার মাঝে আমাদের স্কলার্সহোমের কর্মমুখর দিনগুলো প্রবাহিত হতো। স্যারের পায়ের দৃপ্ত আওয়াজ, তীক্ষ্ন দৃষ্টিভঙ্গি, প্রসারিত সম্বোধন, ন্যায়নিষ্ঠ বিবেচনা আমাদের প্রত্যেকের কর্মপ্রেরণার অনুপম উৎস হয়ে উঠতো। ছাত্র/ছাত্রীদের তিনি যেমন সুনিবিড়ভাবে পরিচর্যা করার নির্দেশনা দিতেন, তেমনি শিক্ষক, কর্মচারী, পিয়ন, বুয়া, সবার প্রতি ছিল তাঁর একনিষ্ঠ ভালবাসা, বিচার-বিবেচনার দৃষ্টিভঙ্গি, আর অপরিসীম শ্রদ্ধাবোধ। অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ, বুদ্ধিমত্তা ও শক্ত হাতে প্রতিষ্ঠানের যে কোনো সমস্যার সমাধান করতেন। তাঁর ব্যক্তিত্বে অন্যতম এবং ব্যতিক্রমী বৈশিষ্ট্য হলো: তিনি যখনই বুঝতে পারতেন অনিচ্ছাকৃতভাবে কারও প্রতি কোন ভুল করেছেন, তখনই তা অনায়াসেই শুধরে নিতেন এবং প্রয়োজনে সেই ব্যক্তির নিকট ক্ষমা প্রার্থনা করতেন। এতো সূক্ষèভাবে নিজের ভুল শুধরে নেয়ার মধ্য দিয়ে তাঁর পরিশীলিত ও পরিচ্ছন্ন মনের পরিচয় মিলে।
তাঁর সততা ও কঠোরতা প্রদর্শন অনেক ক্ষেত্রেই সাধারণের মধ্যে সমালোচনা সৃষ্টি করতো কিন্তু এক সময়ে সকলেরই ভুল ভাঙতো। প্রকৃতপক্ষে এই কঠোরতার পেছনে যে কোমল ও শিশুসুলভ একটি অনিন্দ্য মন যে তাঁর ছিল; সেই স্বর্গীয় হৃদয়ের সন্ধান যারা পেয়েছেন, তারা কখনেই স্যারকে ভালো না বেসে, শ্রদ্ধা না করে থাকতে পারেননি। ২০০৮ সালের জানুয়ারির ১৪ তারিখে স্কলার্সহোমে আমি প্রথম যোগদান করি। ২০১০ সালে মে মাসের ১৫ তারিখ পর্যন্ত আমি কর্মরত ছিলাম। এরপর ‘জালালাবাদ কলেজ’ সোবহানিঘাটে যোগদান করি ২০১০ সালে জুন মাসের ২৩ তারিখে। সেখান থেকে চলে আসার পরও মাঝে মাঝে স্যার খোঁজখবর নিতেন, কথা বলতেন। বিশেষ করে মাধ্যমিক ও উচ্চ মাধ্যমিক পরীক্ষার ফলাফল ঘোষণার পর এবং বছরের দুটি ঈদ অনুষ্ঠানে। আমি ছোট বেলা থেকেই স্বল্পভাষী এবং চাপা স্বভাবের মানুষ। তাই নিজে থেকে কখনোই স্যারকে ফোন দেওয়া হতোনা।
মাঝখানে অনেকদিন বিরতির পর ২০১৭ সালের জুন মাসের শেষের দিকে প্রিন্সিপাল জুবায়ের স্যার, ভি.পি স্যার আশরাফ হোসেন চৌধুরীর মাধ্যমে আমাকে পুণরায় ‘স্কলার্সহোম’-এ যোগদানের জন্য প্রস্তাব দেন। তার দুই দিন পর প্রিন্সিপাল স্যারের সাথে আমি দেখা করতে যাই। স্যারের সেদিনের আন্তরিকতায় মুগ্ধ হয়ে আমি প্রস্তাবটি ফেরাতে পারিনি। স্যার জানতেন, আমার সততা, কর্মনিষ্ঠতা, রুচি, অভিরুচি, আবেগ, বিবেক, মানবতা সব। ছোট্ট মেয়েটির মতোই তিনি যেন আমায় বড় করেছিলেন। আমার সাথে সেদিন স্যারের প্রথম কথাই ছিল: শোন, শামীমা! আমার প্রস্তাব সম্পূর্ণ শুনে, বুঝে এক মাস সময় নিয়ে তারপর তুমি তোমার সিদ্ধান্ত জানাবে। আমরা সবাই তোমাকে আন্তরিকভাবে চাই। শুধুমাত্র তোমাকে নিয়োগের ক্ষেত্রে আমরা সিনিয়র স্কেল নির্ধারণ করেছি। নতুন কেউ যোগদান করলে বিষয়টি অন্যরকম হবে। আমি তখন বি.এড ট্রেনিং টিচার হিসেবেও সিলেট টিচার্স ট্রেনিং কলেজে অতিরিক্ত দায়িত্ব পালন করছিলাম। শুধুমাত্র স্যারের অর্থাৎ আমার বাবার আহ্বানে ২০১৭ সালের ৬ জুলাই দ্বিতীয় বারের মতো স্কলার্সহোমে যোগদান করলাম।
এরপর শুরু হল এক অভিনব নূতন কর্ম অভিজ্ঞতা। শিক্ষক আমার পিতা প্রিন্সিপাল জুবায়ের সিদ্দিকী। কীভাবে কর্মজীবনের প্রতিটি পদক্ষেপকে সুদৃঢ়ভাবে মোকাবিলা করতে হয়, সেই কৌশল তাঁর কাছ থেকেই আমি শিখেছি। যে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ একজনমে সম্ভব নয়। মাতা-পিতার ঋণ শোধ করার ধৃষ্টতা কোন বিবেকবান সন্তানের নেই। কোনোদিন স্যারের কাছে আমি ভুল করেও কটু কথা শুনিনি। যে কোনো অসুবিধার কথা স্যারকে খুলে বলার সাহস রাখতাম। তিনিও কোন বিষয়কে জটিল করে দেখতেন না। জীবনে যেমন সমস্যা থাকবে, তেমনি সমাধানও থাকবে। এই সাহস তিনি তাঁর প্রতিটি সহকর্মীদের প্রদান করতেন।
২০২০ সালে করোনা পরিস্থিতির শুরুতেই ১৭ মার্চ বঙ্গবন্ধুর জন্ম দিনে তাঁর সাথে আমাদের শেষ বৈঠক হয়। কিন্তু এক সপ্তাহ পর ২৫ মার্চ রাতেই তিনি এই বসুন্ধরার মায়া ত্যাগ করবেন তা আমরা ভাবতে পারিনি। এই মহাপ্রস্থান মেনে নেয়া ছিল দুষ্কর! স্যারের চলে যাওয়ার কিছুদিন পূর্বেই তাঁর জন্য খুব মন কাঁদছিল; কারণ তার শরীরটা ভালো যাচ্ছিলনা। চকলেট খুব পছন্দ করতেন। তাঁর শেষ জন্মদিনে একটি ক্যানভরা চকলেট দিতেই হাসিমুখে বলে উঠলেন-এসবের কোন প্রয়োজন ছিলনা, মুখে শুভেচ্ছা জানালেই চলতো।
তাঁর শূন্যতা অপূরণীয়, তাঁর উপস্থিতি অভাবনীয়, তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি তাড়িত, তাঁর কর্মচ লতা সমুদ্রের উচ্ছ্বসিত জলরাশির মতো আজও ভাসিয়ে নেয় কর্মলোকের জগতে। তাঁর সহযোগিতার হাত ও হৃদয় সর্বদা দুঃখী ও বিপদগ্রস্থ মানুষের জন্য ছিল উন্মুক্ত। কাঁধের পিছনে ভরসার শক্ত হাত রেখে অসহায় ও আহত মানুষটিকে বলতেন: আমি তো আছি, ছুটে চল, কাজ কর।
পিতৃস্নেহ, পিতৃপ্রেম সবসময় জ্বলজ্বল করত তাঁর আসা যাওয়ার পথে আমাদের জন্য, আমাদেরই মতো অধম সন্তানদের পৃথিবীতে সুন্দরভাবে বাঁচিয়ে রাখবেন বলে।
বড় বড় প্রতিষ্ঠানের এবং সমাজের হর্তা-কর্তা ব্যক্তি থেকে শুরু করে পিয়ন, বুয়া, ঝাড়ুদার, মালি সবার প্রতি তাঁর আত্মীয়সুলভ আচরণ বিরল ব্যক্তিত্বের এক অন্যন্য নিদর্শন! স্যারের তিরোধানের পর তাঁর বিয়োগ ব্যথায় চোখের জল ফেলেনি, এমন কাউকে দেখিনি। পাষাণের হৃদয়ও বিগলিত হয়েছে তাঁরই প্রেমের ফল্গুধারায়।
করোনা পরিস্থিতির বিপর্যয়ের কথা ভুলে গিয়ে শুধু ভাবছিলাম কীভাবে বাঁচব বাবাকে ছাড়া! কেন বাবা আমাকে একাকী করে চলে গেলেন! কেন বলেছিলেন: ঘরের মেয়ে ঘরে ফিরে এসেছো, আমরা খুব আনন্দিত। আমি আমার ছোট্ট মেয়েটিকে পেয়েই গর্বিত।
ভালো থাকুন স্যার!
ভালো থাকুন পিতা!
ভালো থাকুন মহামানব!
ভালো থাকুন বাবা আমার বাবা!
আমার কর্মময় জীবনের জ্যোর্তিময় ঈশ্বর! আমার জন্মদাতা বাবার জীবন্ত দ্বিতীয় প্রতিচ্ছবি: ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জুবায়ের সিদ্দিকী।
লেখক: প্রভাষক, বাংলা বিভাগ, স্কলার্সহোম, শাহী ঈদগাহ, সিলেট।