সিন্ডিকেটের কবলে সিলেটের আদালতপাড়া
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৬ অক্টোবর ২০২১, ৯:৪৪ অপরাহ্ণ
পূবের হাওয়া ডেস্ক :::
সিলেটের আদালতে কোর্ট ইন্সপেক্টর, জিআরও এবং দালাল সিন্ডিকেটের কারণে ভোগান্তিতে পড়ছেন বিচারপ্রার্থীরা। মামলার নকল সরবরাহ, ওয়ারেন্ট প্রেরণ, ওয়ারেন্ট ‘গায়েব’ প্রত্যেকটি কাজেই চলছে সিন্ডিকেট বাণিজ্য। আদালতের নির্দেশনা নিয়েও চলছে লুকোচুরি। ফলে আদালত পাড়ায় এসি প্রসিকিউশনের কার্যালয়ে ভূক্তভোগীদের আহাজারি প্রতিদিনকার ঘটনা।
সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের শাহপরান জিআরও শাখায় চলছে নানা অনিয়ম। কোর্ট ইন্সপেক্টর আশরাফ আলী ও জিআরও জাকির হোসেন এবং বিভিন্ন মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা মিলে একটি সিন্ডিকেট তৈরি করেছেন। তারা বিচারপ্রার্থীদের নানাভাবে হয়রানি করে থাকেন। আদালতে বিচারকদের নির্দেশনা নকল শাখায় প্রেরণে বিলম্ব ও আদেশ লুকিয়ে রাখার বিনিময়ে তারা প্রতিদিনই হাতিয়ে নেন লক্ষাধিক টাকা। এছাড়া ওয়ারেন্ট লুকিয়ে রাখার বিশাল বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে এ চক্র। দালাল চক্র দ্বারা প্রভাবিত হয়ে মামলার নথিও অনেক সময় গায়েব করে দেওয়ার অভিযোগ দীর্ঘদিনের।
সম্প্রতি জিআরও জাকির আদালত পাড়ায় এক চাঞ্চল্যকর ঘটনার জন্ম দিয়েছেন। বিচারকের আদেশপত্রে স্বাক্ষরের আগেই আসামী দ্বারা বশীভূত হয়ে থানায় বাদীর বিরুদ্ধে প্রসিকিউশনের পত্র পাঠান। উল্লেখ্য ২০২০ সালের ১০ নভেম্বর সিলেট মেট্রোপলিটন পুলিশের শাহপরান থানায় ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাতের অভিযোগে শাহপরাণ জিআর নং-১৭২/২০২০ইং মামলা দায়ের করেন সিলেট নগরীর রায়নগরের বাসিন্দা মুজিবুর রহমান। মামলায় আসামী করা হয় শিবির ক্যাডার মারজান উল হকসহ অজ্ঞাত আরো ৩ জনকে। মামলার অভিযোগে বাদী উল্লেখ করেন, ভূমি বিক্রি সংক্রান্ত লেনদেনের কারণে মারজান প্রতারণার মাধ্যমে ১ কোটি ৮০ লাখ টাকা আত্মসাত করেন।
এ ঘটনায় তদন্ত শেষে শাহপরান (রহ.) থানার এসআই চন্দ্রশেখর গত ২৭ জুলাই সিলেট মেট্রোপলিটন ম্যাজিস্ট্রেট প্রথম আদালতের বিচারক সাইফুর রহমানের আদালতে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। পাশাপাশি ২১১ ধারায় বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করেন তিনি। পরে মামলার বাদী মুজিবুর রহমান গত ৩১ আগস্ট নারাজী দাখিল করেন। নারাজীতে মুজিবুর রহমানের আইনজীবী উল্লেখ করেন, মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা আসামী দ্বারা বশীভূত হয়ে চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করেন। তদন্ত চলাকালে তদন্তকারী কর্মকর্তা বদলানোর জন্য পুলিশ কমিশনারের কাছে লিখিত আবেদন করলেও কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে তড়িঘড়ি করে একটি সাজানো চুড়ান্ত প্রতিবেদন দাখিল করা হয়।
এদিকে আদালত এ প্রতিবেদনের উপর ভিত্তি করে গত ১ সেপ্টেম্বর, ৮ সেপ্টেম্বর, এবং ৯ সেপ্টেম্বর তারিখে ৩ দফা শুনানী শেষে উন্মুক্ত আদালতে বিচারক চুড়ান্ত প্রতিবেদন গ্রহণ করে বাদীর বিরুদ্ধে ২১১ ধারায় ব্যবস্থা নেওয়ার আদেশ ঘোষণা করেন। সাথে সাথে মামলার বাদী মুজিবুর রহমান মামলার সমূহ কাগজাদি, সমূহ আদেশ এর ফটোকপি নকল চেয়ে সংশ্লিষ্ট শাখায় আবেদন করেন। কিন্তু বিগত ২৯ দিনেও শাহপরান থানার জিআরও জাকির হোসেন মামলার সমূহ কাগজাদি নকল শাখায় প্রেরণ করেন নি।
জাকির হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি জানান, আদালত যদি ২৯ দিনেও আদেশ লিখে স্বাক্ষর না করেন, তাহলে আমার কী করার আছে? কিন্তু বাদীপক্ষের আইনজীবী জানতে পারেন দুদিন আগে বাদীর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য শাহপরান থানায় নথি প্রেরণ করা হয়েছে।
কোর্ট ইন্সপেক্টর আশরাফ আলী এ ব্যাপারে বলেন, বিষয়টি আমার জানা নেই। সম্পূর্ণ বিষয়টি নিয়ন্ত্রণ করেন জিআরও জাকির হোসেন। এই মূহূর্তে আমার কাছে এ ধরণের কোনো কাগজপত্র বা তথ্য নেই।
জিআরও জাকির হোসেন নথি প্রেরণের সত্যতা স্বীকার করে বলেন, আদালতের নির্দেশে শাহপরান থানায় নথি প্রেরণ করা হয়েছে। কিন্তু চুড়ান্ত প্রতিবেদনে ও ১ সেপ্টেম্বরের আদেশে বিচারকের স্বাক্ষর না থাকায় নকলের জন্য নথি নকল শাখায় প্রেরণ করা যাচ্ছে না। নথিতে বিচারকের পূর্ণাঙ্গ স্বাক্ষরের আগেই সংশ্লিষ্ট থানায় নথি প্রেরণের কারণ জানতে চাইলে জিআরও জাকির হোসেন প্রতিবেদককে ধমক দিয়ে বলেন, সবকিছু কী আপনাদের বলতে হবে। যা জানার সিএমএম-১ এর বিচারক সাইফুর রহমানের কাছ থেকে জেনে নিন। এটা একটা বিশেষ মামলা, উপর মহলের নির্দেশে বিচারক নিজেই এর তদারকী করছেন।
মামলার বাদী মুজিবুর রহমান বলেন, একটি কুচক্রী মহলের চক্রান্তে আমি ন্যায় বিচার প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত হওয়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। প্রকাশ্যে আদালতে আদেশ ঘোষণার ২৯ দিন পরও আদেশের নকল কর্তৃপক্ষ আটকে রেখেছেন। তাদের কারণে আমি আত্মপক্ষ সমর্থণের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছি। মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা, আসামী মারজান, কোর্ট ইন্সপেক্টর, জিআরও মিলে একটি অদৃশ্য শক্তি সম্পূর্ণ বিষয়টি পরিচালনা করছে।
উল্লেখ্য মারজান উল হক বাংলাদেশ ইসলামী ছাত্রশিবিরের একজন সক্রিয় সদস্য ছিলেন। তার ভাই আল মামুন জামায়াতের মালিকানাধীন ইবনে সিনা হাসপাতাল, সিলেটের একজন পরিচালক। জামায়াত নেতা আল মামুন একটি হত্যা মামলায় পলাতক আসামী হয়ে স্পেন পালিয়ে গিয়েছিলেন। মারজান উল হকের বিরুদ্ধে নারী নির্যাতনসহ একাধিক জালিয়াতির মামলা রয়েছে।
এদিকে গতকাল বুধবার বিকেলে জিআরও জাকির হোসেনের কক্ষে তথ্য সংগ্রহের জন্য গিয়ে দেখা যায়, তিনি একটি স্যান্ডো গেঞ্জি পড়ে নিজ চেয়ারে বসে আছেন। তার পায়ের মোজা টেবিলের ওপর রাখা রয়েছে। এর আশপাশে ছড়িয়ে রয়েছে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মামলার নথিপত্র। নকলের ব্যাপারে পুনরায় জিজ্ঞাসা করা হলে, জাকির জানান, স্যারের দস্তখত হলেই আমরা নকল শাখায় পাঠিয়ে দেবো।