করোনায় মানবিক মূল্যবোধের বিপর্যয়
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ এপ্রিল ২০২০, ৯:১৩ অপরাহ্ণবিশ্বজুড়ে এখন আতঙ্কের নাম করোনাভাইরাস। চীনের উহানে উৎপত্তির মাস দুয়েক পর গত ৮ই মার্চ বাংলাদেশে প্রথম করোনা রোগী শনাক্ত হয়। এরপরেই নড়েচড়ে বসে সরকার। প্রথম মৃত্যুর ঘটনা ঘটে ১৮ মার্চ। এরপর থেকেই দিন যতো গড়াচ্ছে, করোনা রোগীর সংখ্যা ও মৃত্যু ততোই বাড়ছে। অন্যদিকে বদলে যাচ্ছে আমাদের জীবন-জীবিকা-মানসিকতা-মানবিকতা।
এটা বলার অবকাশ নেই যে, আমরা একটা কঠিন সময়ের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। সরকারিভাবে সাধারণ ছুটি ঘোষনার পর থেকেই খেটে খাওয়া মানুষ চরম বিপর্যয়ের মধ্যে পড়েছে। বিশেষ করে যারা দিনমজুর, রিকশা-ভ্যান চালক, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী প্রত্যেকেই কর্মহীন হয়ে পড়েছে। সংসার চলার মতো ন্যূনতম উপার্জন যখন বন্ধ হয়ে যায়, তখন তাদের অসহায়ের মতো সরকারী-বেসরকারী সাহায্যের জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
ইতোমধ্যেই আমরা পোশাক শিল্পের শ্রমিকদের অবস্থা দেখেছি, মালিক পক্ষের হঠকারী ঘোষণা ও সিদ্ধান্তের কারনে তাদের ঢাকা ছেড়ে বাড়ি যাওয়া আবার হটাৎ ঢাকায় ফেরত আসা নিয়ে চরম ভোগান্তির শিকার হতে হয়েছেন তারা। কৃষকদের অবস্থা আমরা সামজিক যোগাযোগ মাধ্যমে দেখছি, উৎপাদিত পণ্যের সঠিক মূল্য না পাওয়ায় তারা হতাশা ও উৎকন্ঠায় দিন কাঠাচ্ছেন। ন্যায্যমূল্যের জন্য তারা সরকারের হস্তক্ষেপ আশা করছেন।
সরকার প্রথম থেকেই বলার চেষ্টা করেছে, তারা সকল শ্রেণীর পেশার মানুষের কথা ভেবেই বিভিন্ন প্রণোদনা, সহায়তা ঘোষণা কিংবা পর্যাপ্ত ত্রাণের ব্যবস্থা করবে। দেশে কোন খাদ্য ঘাটতি নেই বলে জনসাধারণকে বারবার নিশ্চয়তা দেওয়া হচ্ছে। তারই পদক্ষেপ হিসেবে ন্যায্য মূল্যে চাল (১০টাকা কেজি) চাল বিক্রয়, কিংবা নিত্য প্রয়োজনীয় জিনিস সাধারন মানুষ যেন সহজে স্বল্পমূল্যে ক্রয় করতে পারে সে ব্যবস্থাও করা হয়েছে। কিন্ত এতো কিছুর পর এটাও সত্য যে, মাঠ পর্যায়ে এখন পর্যন্ত সব জায়গায় সরকারী ত্রান সামগ্রী পৌঁছেনি, আবার যতটুকু পৌঁছেছে তা প্রয়োজনের তুলনায় অপ্রতুল। যদিও বেসরকারী (এনজিও, স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা, ব্যক্তিগত) উদ্যোগে বিভিন্ন জায়গায় খাদ্য সামগ্রী, নগদ টাকা, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, সাবান, ওষুধ ইত্যাদি বিতরন করা হচ্ছে।
উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক পরিচালিত মানুষের উপার্জন ও খাদ্য নিরাপত্তায় প্রভাব বিষয়ক এক জরিপে বলা হয়েছে, দেশের ৮৯ শতাংশ মানুষ দারিদ্র্যরেখার নিম্নসীমার নিচে নেমে গেছেন, এদের মধ্যে ১৪ শতাংশ মানুষের ঘরে কোনো খাবার নেই। এমন পরিস্থিতিতে সব জায়গায় পর্যাপ্ত পরিমানে ত্রান পৌঁছাতে হবে নতুবা বিভিন্ন শ্রেণী-পেশার মানুষের দুর্দশা কমবে না। বিশেষ করে প্রান্তিক লোকজন-আদিবাসী, দলিত, জেলে, বয়স্ক-বিধবা নারী, প্রতিবন্ধী মানুষ। তারা যেন সরকারী-বেসরকারী সহায়তা পাওয়ার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পায় সেদিকে অবশ্যই বিশেষ খেয়াল রাখতে হবে।
ব্রিটিশ পত্রিকা গার্ডিয়ান বলছে, করোনাভাইরাস মোকাবেলায় বিশ্বের বিভিন্ন দেশে যে লকডাউন চলছে তাতে ঘরে থাকা নারী ও শিশুর প্রতি সহিংসতা বেড়ে গেছে। চীন, স্পেন, জার্মার্নীসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে নারী ও মেয়ে শিশুরা নিজ গৃহেই নানা ধরনের সহিংসতার শিকার হচ্ছে। আমাদের দেশেও নানা ধরনের সহিংসতার খবর পাওয়া যাচ্ছে, সত্যিই তা উদ্বেগজনক।
গণমাধ্যম থেকে প্রাপ্ত তথ্য, শুধু মার্চ মাসেই বগুড়া, জামালপুর ও কক্সবাজার জেলায় ৬৪টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটেছে এবং তিন শতাধিক পারিবারিক নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে।
দেশের বিভিন্ন স্থানে ত্রাণ নিতে গিয়ে অনেকে সহিংসতার শিকার হচ্ছেন। দেশে নির্যাতনের সংখ্যা যেমন বেড়েছে, ঠিক তেমনি সহিংসতার ধরনও পাল্টে গেছে।
উদাহরন হিসাবে বলা যায়, গত ১৫ এপ্রিল পারিবারিক কলহের জের ধরে ফেনীতে এক ব্যক্তি ফেসবুকে লাইভে এসে তার স্ত্রীকে হত্যা করে। ঘরে নারী নির্যাতনের ঘটনা বহু হচ্ছে। কিছু ঘটনা গণমাধ্যমে আসছে, কিছু ঘটনা অজানাই রয়ে যাচ্ছে।
নারী ও শিশুর উপর সহিংসতাকে এখনই রুখতে হবে। সব ধরনের সহিংসতা প্রতিরোধে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীকে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহন করতে হবে এবং আইনি সহায়তা-প্রদান কার্যক্রম দ্রুত জোরদার এবং আইনি প্রক্রিয়া শেষে দোষীদের কঠোর শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে।
দুঃখজনক হলেও সত্য যে, অতি সচেতনতার নামে মানুষের মানবিক মূল্যবোধের ব্যাপক অবনতি ঘটেছে। এলাকাভিত্তিক করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর থেকেই সরকার দ্রুত ব্যবস্থা নিয়ে আক্রান্ত ব্যক্তির বাড়ী ও তার যোগাযোগে আসা আশেপাশের এলাকা লকডাউন করে দিচ্ছে। আক্রান্ত রোগী ও তার পরিবারের সদস্যরা অমানবিক আচরনের শিকার হচ্ছেন। ঢাকা ও চট্টগ্রামে অনেক এলাকায় করোনা আক্রান্ত বা করোনা উপসর্গ আছে এমন রোগী, বিভিন্ন হাসপাতালে কর্মরত ডাক্তার ও নার্সদেরকে বাড়িওয়ালারা বাসা ছেড়ে দেওয়ার হুমকি দিয়েছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। অনেক অ্যাপার্টমেন্টের ফ্ল্যাট মালিক সমিতির সদস্যরা সিদ্ধান্ত নিয়ে ডাক্তার-নার্সসহ সাংবাদিকদের বাড়ি থেকে বের হওয়া ও ঢোকার নতুন নিয়ম করে দিয়েছেন। যদিও ইতোমধ্যে ডিএমপি ও সিএমপি যথাক্রমে ঢাকা ও চট্টগ্রামে এ বিষয়ে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছেন, এ ধরনের পরিস্থিতির শিকার হলে তাদের দেওয়া নাম্বারে যোগাযোগ করার অনুরোধ জানিয়েছেন। ইতিমধ্যে কয়েকটি অভিযোগের ভিত্তিতে তারা কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছেন।
আমরা দেখেছি, করোনা পরিস্থিতিতে কিছু কিছু এলাকাবাসী তাদের কবরস্থানগুলোর সামনে বড় বড় ব্যানারে লিখে সিটি কর্পোরেশনের নিকট অনুরোধ জানিয়েছিল যেন তাদের এলাকার কবরস্থানে করোনায় মৃত কোন ব্যক্তির লাশ দাফন করা না হয়। বিভিন্ন সোসাইটির উদ্যোগে এলাকার হাসপাতালগুলো যেন করোনা আক্রান্ত ব্যক্তির চিকিৎসা না করে সেজন্য হাসপাতাল বন্ধ করে দিতে নোটিশ দিয়েছে। এলাকাবাসীর বাধার মুখে বন্ধ হয়ে গেছে করোনা রোগীদের জন্য বিশেষ হাসপাতাল নির্মাণ। আমরা কতোটা অমানবিক-অসামাজিক হয়ে গেছি এসবই তার বড় প্রমাণ।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা জানিয়েছে, করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়ে মারা যাওয়া ব্যক্তির শরীর থেকে অন্য কেউ সংক্রমণের প্রমাণ পাওয়া যায়নি। তবে মৃতদেহ সৎকারের সময় হাতের সুরক্ষা ও ব্যক্তিগত সুরক্ষা সরঞ্জাম ব্যবহারের নির্দেশনা দিয়েছে সংস্থাটি। সরকারী ব্যবস্থাপনায় এখন সেটিই পালন করা হচ্ছে এবং বেসরকারী কিছু উদ্যোগ এতে সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিয়েছে।
বিদেশ ফেরত অনেকের শরীরে করোনাভাইরাস পাওয়া গেছে- এটা সত্য, তবে বিদেশ ফেরত মানেই যে করোনা আক্রান্ত এমন ধারনা ভুল। কিন্তু এই ভুল ধারনার উপর ভিত্তি করে সারাদেশে প্রবাসী, কিংবা বিদেশ ফেরত অনেকে ও তার পরিবারের সদস্যরা এলাকার অমানবিক আচরনের শিকার হচ্ছেন। তাদের উপর আক্রমন করা হচ্ছে, তাদের ঘরবাড়ী ভাংচুর করা হচ্ছে, কোথাও কোথাও এলাকা ছাড়ার হুমকিও দেয়া হচ্ছে।
মানবিকতায় আমরা কোথায় নেমে গেছে; এটা ভাবতেই অবাক লাগছে। আমাদের মানবিক মুল্যবোধ অবক্ষয়ের চরমে পৌঁছে গেছে এটা বলাই বাহুল্য। এখনই ব্যাপক জনসচেতনতা বাড়াতে হবে, মানবিক সহায়তা দিয়ে দেশবাসী ও প্রবাসীদের পাশে দাঁড়াতে হবে।
বেশকিছু অমানবিক ঘটনা আমলে নিয়ে গত ১৬ এপ্রিল এক ভিডিও কনফারেন্সে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুঃখ প্রকাশ করে বলেছেন, ‘মানুষ আতঙ্কগ্রস্থ হলে অমানুষে পরিণত হয়। একজন মা জ্বরে আক্রান্ত হলে তার সন্তান-স্বামী তাকে জঙ্গলে রেখে আসে। কতোটা অমানুষ হলে এটা করতে পারে? বাংলাদেশে এরকম আচরণ কেন ঘটবে? করোনা সন্দেহ হলে পরীক্ষা করান, চিকিৎসা করান, যত্ন নিন। জীবন আল্লাহর হাতে। যে কেউ যেকোন সময় মারা যেতে পারেন। করোনা পরিস্থিতি নিয়ে কারো অমানবিক হওয়ার বা আচরণের যৌক্তিকতা নেই।’
প্রধানমন্ত্রীর কথার সাথে একমত হয়েই বলতে চাই- আমাদের এই অমানবিক আচরণ থেকে এখনই বের হয়ে আসতে হবে। নয়তো জাতি হিসাবে আমরা বিশ্বের দরবারে ঘৃণিত হব।
অমানুষের আরেক উদাহরন, করোনা পরিস্থিতিতে দেশের দারিদ্র জনগোষ্ঠিকে ত্রাণ দেয়ার ব্যবস্থা করেছে সরকার। বিভিন্ন জেলায় সেই ত্রাণ চুরি হয়ে গেছে। ত্রান চুরির খবর শুনে আমরা হতাশ হয়ে যাই, জনগনের সেবকদের প্রতি আমাদের আস্থা নষ্ট হয়ে যায়, বেড়ে যায় অসম্মান।
তবে কিছু তরুন স্বেচ্ছাসেবী সংস্থা যারা স্বপ্রণোদিত হয়ে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে খেঁটে খাওয়া মানুষের পাশে দাঁড়াচ্ছেন- এমন চিত্র সত্যিই আমাদের আশান্বিত করে।
করোনা মোকাবেলা যুদ্ধে আমাদের চিকিৎসক, নার্স, সেনাবাহিনী, পুলিশ, সাংবাদিক, প্রশাসনের বিভিন্ন বিভাগসহ সমন্বিত কার্যক্রম যারা পরিচালনা করছেন, যারা নিত্য প্রয়োজনীয় পণ্য সরবরাহ করে করোনা দুর্যোগেও আমাদেরকে সেবা দিয়ে যাচ্ছেন তাদের সবাইকে জানাই ধন্যবাদ ও কৃতজ্ঞতা।
করোনা মহামারি পেরিয়ে নিশ্চয় সুদিন আসবে, তখন করোনা মোকাবিলায় আমাদের ইতিবাচক পদক্ষেপগুলো আমাদের মানবিক মূল্যবোধকে আরো সমৃদ্ধ করতে সাহায্য করবে এই আশা রাখি।
লেখক: প্রোগ্রাম ম্যানেজার, মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন