জ্ঞানভিত্তিক সমাজেই শস্য স্বপ্নের প্রাণস্পন্দন
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মে ২০২০, ৪:৩৪ অপরাহ্ণড. সেলু বাসিত::
বিদ্যা-বুদ্ধি চর্চা বুদ্ধি-জীবিকায় রূপান্তরিত হয়ে আর্থিক মেলবন্ধনে লক্ষির প্রতি আমাদের পক্ষপাত বৃদ্ধি পেয়েছে; অথচ বৃহস্পতির জ্ঞানালোকের পদপাদে সরস্বতীর আলোকরশ্মি আমাদের পাথেয়। ইংরেজী ভাষার একটি প্রবাদ আছে old cultures die hard; বাঙালি ঐতিহ্যে-উদার, ঐতিহ্য চেতনায় বিকাশমান সত্তা ঔপনিবেশিক মানসিকতা থেকে জ্ঞানভিত্তিক জীবনমুখিনতা, স্বদেশমুখিনতা, মনুষ্যমর্যাদাবোধে মতাদর্শগত দেশহিতৈষণা আর নীতিনিষ্ঠ আত্মসত্তার আজ তাই নবজাগরণ অপরিহার্য হয়ে উঠেছে। আমাদের সমাজের মনন ধর্মে মাতৃভূমি, মাতৃভাষা সর্বোপরি মাতৃসংস্কৃতির প্রতি চিত্ত-চৈতন্যের বিকাশমান সত্তায় বৈকল্য-মুক্তি আজ সময়ের দাবি। জ্ঞানভিত্তিক সমাজ বিনির্মাণে মনুষ্যত্ববোধ আর মানবিকতার মানবধর্ম এবং সামাজিক সহনশীলতায় পুনর্জাগরণ আজ প্রগতি চেতনার বিশেষ আকাক্সক্ষা। আজ সাক্ষরতা (Literacy) বৃদ্ধির সাথে সাথে সাংস্কৃতিক সাক্ষরতা (Culturel Literacy) অভিযান তৃণমূল থেকে নতুন আয়োজনে উন্মেষ উত্থানে উদ্যোগ গ্রহণ অপরিহার্য।
জ্ঞানদীপ্তরূপে সবরকমের সা¤প্রদায়িকতা আর ধর্মান্ধতার অসুর নিধনে আজ ললিত কলা-বুদ্ধি-শিক্ষা-ন্যায়-আদর্শ বোধের বাঙালির ঐতিহ্যকে ধারণ করে সমষ্টির আকাক্সক্ষা ও প্রত্যাশায় আমাদের এগিয়ে যাওয়ার প্রত্যয় হোক নৈর্ব্যক্তিক।
\ দুই \
গৌড়-বঙ্গের প্রাচীন ইতিহাস বলে: ‘গুপ্ত কিংবা সেন যুগ থেকে পাঠান সুলতান-মোগল তথা মুসলিম শাসন আমল, ইংরেজদের অধীতা বশ্যতায় পীড়িত ভারতবর্ষে বাঙালি বিদ্যাবত্তা-জ্ঞানবুদ্ধিতে ছিল শীর্ষস্থানে।
বাঙালির সিংহলো জয় থেকে শুরু করে শিল্প সাহিত্যে বাণিজ্য আরাকান আর পাল-সেন শাসনামলে বাঙালি সিংহলো, মালাবার উপকূল জাভা দ্বীপ, সুমাত্রা, বালি, কম্বোজ, চীন পর্যন্ত বাণিজ্যের তীর্থ ও শিল্পবুদ্ধির জয় জয়কার ছিল।’
রবীন্দ্রনাথ বলেছিলেন: “আমাদের বিদ্যার সাধনাকে স্বার্থবুদ্ধি ও বিষয়বুদ্ধি ছোট করেছে, সঙ্কীর্ণ করেছে একে শৃঙ্খলিত করেছে। ছাত্র যে শিক্ষা অর্জন করে তা স্বার্থ বুদ্ধি নিয়ে করে।…… ওরা যে বিদ্যাবুদ্ধি লাভ করে তার মূল্য শুধু হাটে বাজারেই আছে, কিন্তু তার পেছনে মনুষ্যত্ব নেই।”
আজ তাই মূল্যবোধের অবক্ষয় মনুষ্যত্বের বিকাশ, নিজ ভাষার স্বাবলম্বন প্রবণতা ক্রমহ্রাসমান। ভাষার সঙ্গে সঙ্গে সংস্কৃতির সমৃদ্ধি ঘটে, তা আজ বৃত্তাবদ্ধ। বাঙালি ঐতিহ্যপ্রবণ, আমাদের আত্মপ্রবোধ প্রকাশ করলেও মহামহোপাধ্যায় হরপ্রসাদ শাস্ত্রী বলেছেন : “বাঙালি আত্মবিস্মৃত জাতি”ও বটে।
আমাদের মাতৃসংস্কৃতির পেছনে মায়ের মৃদুভাষ ও অনুরাগ প্রবণতা চিত্ত-চৈতন্যে বিকশিত। বাৎসায়ন গৌড়বঙ্গের স্ত্রীলোক মাত্রেই এই বৈশিষ্ট্যের সাথে কোমলাঙ্গের কথাও বলেছেন : ‘মৃদুভাষিণ্যোহনুরাগবত্যো মৃদঙ্গশ্চ গৌড়া: \’ অঙ্গের সাথে সাথে আমাদের হৃদয়ও কোমল বটে। শিক্ষা-দীক্ষা সংস্কৃতি সকল ক্ষেত্রে গৌড়বঙ্গের খ্যাতি সবর্জন বিদিত। পতঞ্জলির মহাভাষ্য অনন্য এক শিক্ষা কেন্দ্র ছিল। সত্যিই আমরা সকলেই আজ বিস্মৃতপ্রায় স্বারস্বত ঐতিহ্যের গৌরব-দীপ্তী।
\ তিন \
ভাববাদী দৃষ্টিভঙ্গিতে নব্য কান্টীয় ভাবধারায়ই যদি ধরি তাহলে দেখা যায় প্রাকৃতিক ও সামাজিক বিজ্ঞানের ক্ষেত্রে Nomotative এবং Idegraphic পদ্ধতির পরিচর্যা করা হয়, ব্যক্তির স্বতঃস্ফূর্ত জ্ঞান Intuition এবং সহানুভূতির মাধ্যমেই বোঝাপড়া এবং জানাকে চেতনার ব্যুৎপত্তির উপাদান বলে মেনে নেওয়া হয়। Theory of socio-economic formationএবং Intuition কে সমনি¦ত দ্বান্দিক প্রক্রিয়ায় উপলব্ধি করলে পরস্পর বিপ্রতীপ অবস্থানকে অবহিত ও বিশ্লেষন করা যায়; শুধু তাই নয় বিষয়বস্তুর গভীরে যেতে মননপ্রক্রিয়া আদর্শগত প্রয়োগপদ্ধতিতে অত্যন্ত বলিষ্ট ভূমিকা পালন করে। তাই, ব্যুৎপত্তিজ্ঞান এবং সমন্বিত দ্বা›িদ্বক প্রক্রিয়া পরস্পর বিপরীতমুখী অবস্থানের এক সাম্য অবস্থান প্রকৃত জ্ঞানতত্বের বৈশিষ্ট্য। বুলগেরীয় জ্ঞান বিশেষজ্ঞ ইয়ানকোভকে স্মরণ করা যায়: ইয়ানকোভ জ্ঞানতত্তে¡র প্রত্যয় এবং মডেলিকরণকে জ্ঞানতত্তে¡র পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের সহায়ক বলে Object এর গতি ও বিকাশকে চিহ্নিত করেন, বিশেষত ব্যক্তি, নীতি ও আত্মজ্ঞানের নৈর্ব্যক্তিক রূপ হিসেবে।
\ চার \
বাংলাদেশ জ্ঞান-চর্চা এখন ল²ীর আরাধনায় মগ্ন। মুক্তবাকচর্চা আজ আত্মনিয়ন্ত্রিত, পাছে লোকে কিছু বলে-পাছে কোন বিধানে সখাত-সলিলে। এ-পরিপ্রেক্ষিতে আজ বড় প্রয়োজন জ্ঞানভিত্তিক সৃষ্টিক্ষম জাতিগত দৃঢ়তা। দেশকে স্বাধীন করা আর মানুষকে স্বাধীন করা এক কথা নয়, আমাদের স্বাধীন নিয়মাচারের বিরুদ্ধে লড়াই করে মানুষের পরাধীনতাকে স্বাধীন করতে হবে। ধর্ম, কোন কোন ধর্ম মানুষকে অধস্তন করে ফেলে, তার বিরুদ্ধে লড়তে হবে। এ-বিশেষ অধিকৃত মানসিক ভিত্তি সম্পর্কে বলা যায়: ঔপনিবেশিক মানসিকতা হলো অধিকৃত ভূখন্ডে কিংবা ছেড়ে আসা জনপদে নিজস্ব আরোপিত কৌশলে সাংস্কৃতিক বিচ্ছিন্নতা সৃষ্টি করে সা¤প্রদায়িক ভেদ-বুদ্ধিকে কাজে লাগিয়ে সম্পর্কের দ্বৈধ সৃষ্টি করা। আমি,-তুমি বলে ‘আমরা’ কে অর্থাৎ সমষ্টিকে দূরে ঠেলে দেওয়া।
ব্যক্তি মানুষের আত্মম্ভরিতা, উচ্চম্মন্যতা আজ আমাদের প্রাতিষ্ঠানিক শৃঙ্খলা, মনুষ্য মর্যাদা, চিন্তার বৈকল্য সৃষ্টি করে মননশীল পরিবেশ, আদবকায়দা, আচরণ-প্রথা-অভ্যাসে মানসিক দৈন্যদশায় আক্রান্ত, সেসব ক্ষেত্রে মহামন্যতার প্রাবল্য। তা থেকে মুক্তির উপায় সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক জাগরণ। সে লক্ষ্যে সর্বজনীন উৎসব, সাংস্কৃতিক এবং সামাজিক উৎসবগুলো অনুপ্রেরণার উৎস হতে পারে।
নববর্ষের উৎসব, বসন্তের উৎসব, বর্ষামঙ্গল পালাবন্ধনা কিংবা শারদীয় মেলা পার্বণ আনন্দময় শুধু আনন্দ নয়, কৃষিভিত্তিক বাঙালির মৌল-উৎস থেকে জ্ঞানভিত্তিক সমাজবন্ধন আর গণচেতনা সন্নিবেশের এক শস্য স্বপ্নের প্রাণস্পন্দনও বিশেষ। কারণ জ্ঞানভিত্তিক সমাজেরই আলোকরশ্মি শস্য স্বপ্নের প্রাণস্পন্দনে নিহিত।
লেখক : গবেষক, কলামিস্ট।