ধর্ষণ চেষ্টার আগেই তৈরি হয় এজাহার
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ জুন ২০২১, ৯:৫১ অপরাহ্ণস্টাফ রিপোর্টার ::: ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে, আগে থেকে তৈরি করা এজাহারে ফাঁসানো হয়েছে গোলাপগঞ্জ উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের শ্রী শ্রী গৌরগিরিধারী জীউ মন্দিরের সেবায়েত প্রাণ গোবিন্দ দাস ওরফে পরেশ চৌহানকে। এ ঘটনায় সেবায়েত পরেশ চৌহান কয়েকদিন কারাবন্দি ছিলেন।
গ্রেফতারের সময় পুলিশি নির্যাতনে কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে কারাপুলিশের তত্বাবধানে সিলেট এমএজি ওসমানী মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে পায়ুপথে অস্ত্রোপচারও করা হয় সেবায়েতের।
অনুসন্ধানে ধর্ষণ চেষ্টা মামলার নেপথ্যে ভয়াবহ তথ্য বের হয়ে এসেছে। পূর্ব পরিকল্পনার অংশ হিসেবে ভূমি সংক্রান্ত বিরোধের জের ধরে স্থানীয় গ্রাম পুলিশের কিশোরীকন্যা (১৬) বাদি হয়ে গত ১৪ এপ্রিল বেলা আড়াইটায় এ মামলা করেন। ওইদিনই পুলিশ বিকেল সাড়ে ৪ টায় উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের কালাকোনা অধিরের দোকান নামক এলাকা থেকে মন্দিরের সেবায়েত পরেশ চৌহানকে গ্রেফতার করে।
গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়ার সময় খেয়াখাটে বাদির বোনের সাথে সাক্ষাৎ হয় গোলাপগঞ্জ থানার এসআই জাহাঙ্গীরের সাথে। এ সময় বাদির বোন তুলি রানীর সাথে এসআই জাহাঙ্গীর খোশগল্প শুরু করেন।
এ সময় তুলি মজা দেখানোর কথা বলে হুমকি দিলে এসআই জাহাঙ্গীর সেবায়েত পরেশ চৌহানের পায়ু বরাবর বুট দিয়ে লাথি দিলে রক্ত ঝরতে শুরু করে। পরবর্তীতে সেবায়েতকে কারাগারে পাঠানোর পর ২৬ এপ্রিল কারাপুলিশের তত্বাবধানে হাসপাতালে অস্ত্রোপচার করা হয়।
মামলার নথি পর্যালোচনা ও সংশ্লিষ্টদের সাথে আলাপকালে জানা যায়, ধর্ষণ চেষ্টার মামলায় ঘটনার তারিখ উল্লেখ করা হয়েছে ১৩ এপ্রিল সন্ধ্যা ৭টা। স্থানীয় হাজী আবদুল আহাদ উচ্চবিদ্যালয়ের দশম শ্রেণীর ওই ছাত্রী প্রকৃতির ডাকে সাড়া দিয়ে ঘর থেকে বের হলে পরেশ চৌহান ও তার সহযোগি দীপংকর দেব তপন ধর্ষণের চেষ্টা করেন।
অথচ মন্দিরের সিসিটিভি ফুটেজ পর্যালোচনায় দেখা যায়, মামলায় উল্লেখিত তারিখে সন্ধ্যা ৬টা ৩৯ মিনিট থেকে ৮টা ০৭ মিনিট পর্যন্ত মন্দিরে গীতাপাঠরত অবস্থায় ছিলেন সেবায়েত পরেশ চৌহান।
মন্দিরের পরেশ চৌহান জানান, পুলিশ তদন্ত ছাড়াই পূর্বপরিকল্পনার অংশ হিসেবে এ মামলা নিয়েছে। মামলায় ঘটনার যে সময় উল্লেখ করা হয়েছে, সে সময়ে আমি গীতাপাঠরত ছিলাম।
যা মন্দিরের সিসিটিভি ফুটেজে স্পষ্ট প্রতীয়মান হয়। পুলিশ যদি নিরপেক্ষভাবে মামলা গ্রহণ করতো তবে তদন্তে বিষয়টির সত্যতা পেতো।
আমাকে সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন ও মন্দিরের ভূমি আত্মসাতের জন্য এ ষড়যন্ত্র করা হয়েছে। পুলিশ কোনোভাবেই এর দায় এড়াতে পারবে না। কার নির্দেশে গোলাগপঞ্জ থানা পুলিশ এমন কাজ করছে তার রহস্য উদঘাটন জরুরী।
এদিকে খোঁজ নিয়ে মন্দিরের সেবায়েতের অভিযোগের সত্যতাও মিলেছে। ঘটনার ৩ দিন আগেই গত ১০ মে এ মামলার এজাহার তৈরি করার জন্য সিলেট জেলা জজ আদালতের আইনজীবীর বাসা থেকে মামলার এজাহার তৈরি করা হয় পুলিশের নির্দেশে। জজ আদালতের এডভোকেট অসীম কুমার দাস বলেন, ১০ এপ্রিল আরেকজন আইনজীবী এ ধরণের মামলা লিখে দিতে অনুরোধ করেন।
ওই আইনজীবী বলেছিলেন, নারী নির্যাতন কিংবা অন্য যেকোনো ধারায় মামলা লিখে দিলেই চলবে। ওই আইনজীবী জানিয়েছিলেন, মেয়ে ও মেয়ের ভাই নাকি পুরোহিতের দায়ের করা চাঁদাবাজি মামলার আসামি। দুজনই জামিনে আছে। তবে মূল বিরোধ জমি নিয়ে।
আদালত বন্ধ, এ ধরণের মামলা থানায় নেবে কী না এডভোকেট অসীমের এমন প্রশ্নের জবাবে ওই আইনজীবী বলেছিলেন, পুলিশ বলেছে মামলা লিখে দিতে, তারা এফআইআর করবে।
এডভোকেট অসীম কুমার দাস আরো বলেন, জেলা পরিষদের মহিলা সদস্য হাসিনা বেগমকে সাথে নিয়ে ওই আইনজীবীর সাথে দেখা করেন ভাই বোন। পরে ওই আইনজীবী এ ধরণের একটি মামলা লিখে দেওয়ার অনুরোধ জানালেও পরে আর যোগাযোগ করেন নি।
এ ব্যাপারে জেলা পরিষদের মহিলা সদস্য হাসিনা বেগম বলেন, আমি জনপ্রতিনিধি হিসেবে সবার কাজে এগিয়ে যাই। ধর্ষণ চেষ্টার আগে ও পরে বাদির পরিবারের লোকজন আমার সাথে দেখা করেছে। আমি ওসিকে বলেছি সঠিক হলে মামলা নিতে।
গোলাপগঞ্জ থানার ওসি হারুন অর রশিদ চৌধুরী বলেন, ১০ এপ্রিল কেউই আমার কাছে তৈরি করা এজাহার নিয়ে আসে নি। আমি সংশোধন করার প্রশ্নই ওঠে না। ঘটনার পর এজাহার দিলে মামলা রেকর্ড হয়।
এলাকার লোকজন ও গিরিধারী মন্দিরের ভক্তরা জানান, মন্দিরের ভূমি নিয়ে দীর্ঘদিন থেকে বিরোধ চলে আসছে। বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য স্থানীয়ভাবে ও প্রশাসনের লোকজন সমস্যা সমাধান করার জন্য একাধিকবার চেষ্টাও হয়েছে। সেবায়েত গ্রেফতার ভূমি বিরোধের পূর্বপরিকল্পনার একটি অংশ। গত এক বছর ধরে মন্দিরের পার্শ্ববর্তী ঘরের বাসিন্দা ঋষি দেবের পরিবারের সাথে মন্দিরের ভূমি নিয়ে বিরোধ চলে আসছিল। তাদের বাঁধার কারণে মন্দিরের একটি অংশের কাজ অর্ধেক করার পর বন্ধ হয়ে যায়। এ নিয়ে সেবায়েত প্রাণ গোবিন্দ দাস ওরফে পরেশ চৌহানের ওপর ঋষির পরিবার একাধিক বার হামলা করে। ২০১৯ সালে হামলা ও চাঁদা দাবীর অভিযোগ এনে সেবায়েত আদালতে একটি মামলা করেন। ওই মামলায় ঋষি ও তার পরিবারের সদস্যরা আদালত থেকে জামিন নিয়ে এসে নতুন করে ষড়যন্ত্রের পরিকল্পনা শুরু করে।
স্থানীয়দের অভিযোগ বিচারাধীন মামলায় হেরে যাওয়ার শঙ্কায় মামলার বাদি সেবায়েত ও ভূমিদাতার পরিবারকে হেনস্থা করতে পরিকল্পনা শুরু করে। এর জেরেই সেবায়েতকে পরিকল্পিতভাবে মামলা দিয়ে ফাঁসানো হয়েছে। সেই সাথে মন্দিরের ভূমিদাতা দীপংকর দেব তপনের চরিত্রহননের লক্ষ্যে অভিযুক্ত করা হয়েছে একই মামলায়।
স্থানীয়রা জানান, উপজেলার বাঘা ইউনিয়নের কালাকোনা গ্রামে শ্রীশ্রী গিরিধারী জিউ মন্দিরের সেবায়েত হিসাবে দায়িত্ব পালন করছেন টাংগাইল জেলার দেলদোহার থানার সিলিমপুর গ্রামের কালু চৌহানের ছেলে প্রাণ গোবিন্দ দাস ওরফে পরেশ চৌহান বাবাজি (৪৬)। ২০১৯ সালের ২৩ আগস্ট মন্দিরের নির্মাণ কাজে বাধা প্রদানসহ ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবী করে স্থানীয় ঋষিময় দেবের পরিবারের লোকজন। পরে একই বছরের ২২ ডিসেম্বর পুনরায় মন্দিরে ঢুকে চাঁদা দাবী। এ সময় চাঁদা দিতে সেবায়েত অপারগতা প্রকাশ করলে শারিরীক নির্যাতনের শিকার হন। এ ঘটনায় মন্দিরের সেবায়েত বাদি হয়ে মামলা করেন। মামলার তদন্তভার প্রথমে পুলিশ ও পরে সিআইডিকে দেওয়া হলে ঘটনার সত্যতা পাওয়া যায়। পরবর্তীতে সেবায়েতকে নানাভাবে ফাঁসানোর হুমকি দিলে নিজের ও মন্দিরের নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে সিসিটিভি ক্যামেরাও স্থাপন করা হয়।
স্থানীয় প্রণব দেব জানান, বাদি পরিবার মন্দিরের জায়গা দখল করে বসতঘর নির্মাণ করেছে। মন্দিরের নির্মাণ কাজেও তারা বাধা সৃষ্টি করছে। জায়গা সংক্রান্ত বিরোধের জেরে কয়েকবার গোবিন্দ দাস বাবাজির উপর তারা নির্যাতন করেছে। পরিকল্পিতভাবে মন্দিরের ভূমিদাতার ছেলে ও সেবায়েতকে ফাঁসানো হয়েছে।
সেবায়েত প্রাণ গোবিন্দ দাসকে যে দোকান থেকে গ্রেফতার করা হয় ওই দোকানের স্বত্বাধিকারী দুলন দেব জানান, তিনি বাজার থেকে ফলমুল কিনে আমার দোকানে বসা ছিলেন। এসময় সাদা পোষাকে পুলিশ এসে সেবায়েতকে গ্রেফতার করে। গ্রেফতারের কারণ জানতে চাইলে তারা এ ঘটনার কথা জানায়।
এ বিষয়ে বাদির প্রতিবেশী লিংকন কান্ত দেব জানান, বাদির বসতঘরে পাকা বাথরুম থাকা সত্ত্বেও বাড়ির বাইরে জরাজীর্ণ বাথরুমে তাও রাতের বেলা একটি মেয়ে কেন যাবে ? এরকম কোন ঘটনা ঘটলে প্রতিবেশিরা শুনতে পেতেন। এছাড়া মন্দিরের সিসিটিভি ফুটেজেও ধরা পড়তো।
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাংগঠনিক সম্পাদক হরিপদ রায় বলেন, সিলেট জেলা আওয়ামী লীগের কার্যনির্বাহী সদস্য ও প্রভাবশালী এক নেতার ইন্ধনে সেবায়েতকে ষড়যন্ত্রমূলকভাবে ফাঁসানো হয়েছে। তিনি প্রভাবশালী ওই নেতা হুমকীর কথা উল্লেখ করে বলেন, আমরা বাচঁতে চাই, আমরা এদেশে বসবাস করতে চাই। বঙ্গবন্ধু সোনার বাংলায় আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী নেতা সংখ্যালগু লোকজনকে মামলা হামলা দিয়ে হয়রানী করছেন, এটা তো মেনে নেওয়া যায় না। তিনি এ ব্যাপারে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করেন।
এদিকে সেবায়েতকে গ্রেফতারের সময় নির্যাতন করে পায়ুপথে রক্তক্ষরণের ঘটনার তদন্ত শুরু করেছে পুলিশ সুপারের কার্যালয় থেকে গতকাল সোমবার রাতে অভিযুক্ত ও অভিযোগকারীর বক্তব্য শুনেছেন গোলাপগঞ্জ সার্কেলের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার।