করোনা : লকডাউনে দিনে ক্ষতি ৩৩০০ কোটি টাকা
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ এপ্রিল ২০২০, ৭:৫৬ অপরাহ্ণপূবের হাওয়া ডেস্ক
করোনাভাইরাস মোকাবেলায় চলমান লকডাউনে ঢাকার ব্যস্ততম সড়কগুলোতে নেই যান চলাচল, বন্ধ হয়ে আছে সব ধরনের কল-কারাখানা। করোনাভাইরাস মহামারী মোকাবেলায় চলমান লকডাউনে কী পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হচ্ছে তার কোনো সরকারি হিসাব এখনও আসেনি; তবে দিনে এই ক্ষতির পরিমাণ তিন হাজার ৩০০ কোটি টাকার কম নয় বলে মনে করছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক।
অতি সংক্রামক এই ভাইরাসের বিস্তার রোধে গত ২৬ মার্চ থেকে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করে সবাইকে ঘরে থাকার পরামর্শ দিয়েছে সরকার। এ সময় সব ধরনের কল-কারখানাসহ বাইরের সব কাজকর্ম বন্ধ রয়েছে। আগামী ২৬ এপ্রিল পর্যন্ত এই ছুটি রয়েছে।
এই এক মাস বাংলাদেশ কী পরিমাণ অর্থনৈতিক ক্ষতির সম্মুখীন হচ্ছে প্রাথমিকভাবে তার একটি ধারণা দেওয়ার চেষ্টা করেছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের ওই গবেষক দল।
তাদের হিসাবে, এই এক মাসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। এর পরে লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ বাড়বে।
মঙ্গলবার ‘অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদনে এই হিসাব দেন তারা। গবেষক দলের প্রধান অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ জানান, “২০১৮-২০১৯ সালের জিডিপির ভিত্তিতে বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে স্বল্পমেয়াদি বা চলতি ক্ষতির পরিমাণ কত হবে তা হিসাব করার একটা প্রয়াস নেওয়া হয়েছে। ক্ষতি প্রশমনে বাংলাদেশকে এই মুহূর্তে বাস্তবসম্মত পদক্ষেপ গ্রহণের কথা ভাবতে হবে।”
তিনি বলেন, “কৃষি, শিল্প ও সেবা খাতে গড়ে মোট অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে ৩ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। প্রতি দিনের এই চলতি ক্ষতির পরিমাণ লকডাউন অবস্থার মেয়াদ বৃদ্ধির সাথে সাথে বাড়তে পারে, যা এই মুহূর্তে হিসাব করা সম্ভব হয়নি।”
পুরো মে মাস লকডাউন থাকলে ক্ষতির পরিমাণ দুই লাখ কোটি টাকা (গত অর্থবছরের জিডিপির প্রায় ৯ শতাংশ) ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে মনে করছে এই গবেষক দল।
বাংলাদেশের অর্থনীতির তিনটি বড় খাত- কৃষি, শিল্প ও সেবা খাত ধরে ক্ষতির অনুমিত হিসাব দেওয়া হয়েছে এই সমীক্ষা প্রতিবেদনে।
তাদের হিসাবে লকডাউনের কারণে প্রতিদিন কৃষিতে ক্ষতি হচ্ছে ২০০ কোটি টাকা। প্রতিবেদনে বলা হয়, কৃষির প্রধান উপখাতগুলো হল শস্য উৎপাদন, প্রাণি সম্পদ ও মৎস্য সম্পদ। স্বল্প মেয়াদে এই সব উপ খাতে উৎপাদন না কমলেও দেশি-বিদেশি অর্থনীতি অবরুদ্ধ থাকায় এ সব উপ-খাতের উৎপাদিত দ্রব্যের মূল্যের উপর নিম্নমুখী প্রভাব পড়তে শুরু করেছে। এর ফলে অর্থনীতিতে প্রতিদিন প্রায় ২০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে।
তাদের হিসাবে শিল্প খাতে দিনে ক্ষতি হচ্ছে এক হাজার ১৩১ কোটি টাকা।
প্রতিবেদনে বলা হয়, উৎপাদন ও নির্মাণ খাতে ক্ষতির মাত্রা প্রকট আকার ধারণ করেছে। এ খাতে প্রতি দিনের অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ১৩১ কোটি টাকা ।
সেবা খাতে দিনে ২০০০ কোটি টাকার ক্ষতি হচ্ছে বলে সমীক্ষায় বলা হয়েছে।
প্রতিবেদনে বলা হয়, অর্থনৈতিক ক্ষতি সবচেয়ে প্রকট আকার ধারণ করেছে সেবা খাতে। নিত্য প্রয়োজনীয় দ্রব্যসামগ্রী বেচা-কেনা এবং জরুরি সেবা ছাড়া এই খাত মূলত অবরুদ্ধ। সব ধরনের যোগাযোগ (সড়ক, রেল, নৌ ও আকাশ পথ), পর্যটন, হোটেল ও রেস্টুরেন্ট, রিয়েল এস্টেটসহ সব ধরনের সেবা একেবারেই বন্ধ। স্বাস্থ্য খাতের বেসরকারি অংশটিতেও এক প্রকার অচলাবস্থা বিরাজ করছে। সব মিলিয়ে সেবা খাতে প্রতি দিনের অনুমিত চলতি ক্ষতির পরিমাণ কমপক্ষে দুই হাজার কোটি টাকা ।
অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলেন, “এই হিসাবটি একদিকে যেমন সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজ যথেষ্ট কি না তা নিরূপণ করতে সাহায্য করবে, অন্যদিকে প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের উপর জোর দেওয়ার তাগিদও অনুভূত হবে।”
তিনি বলেন, বাংলাদেশ সরকারও বড় অঙ্কের (প্রায় ৯৫ হাজার কোটি টাকা) প্রণোদনা প্যাকেজ ঘোষণা করেছে। এই প্যাকেজ অর্থনীতিতে কতটুকু গতি ফিরিয়ে আনতে পারবে তা নির্ভর করবে স্বল্প মেয়াদি, মধ্য মেয়াদি এবং দীর্ঘ মেয়াদি মোট ক্ষতির পরিমাণ এবং প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের উপর।
অধ্যাপক আব্দুল হামিদ বলেন, “২৬ মার্চ থেকে ২৫ এপ্রিল পর্যন্ত ৩১ দিনের অবরুদ্ধ অবস্থায় অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে কমপক্ষে ১ লাখ ২ হাজার ৩০০ কোটি টাকা। যেহেতু পুরো এপ্রিল মাসকে করোনাভাইরাসের ভয়াবহতা হিসেবে আশঙ্কা করা হচ্ছে তাই ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত লকডাউন অব্যাহত থাকলে এই ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে প্রায় ১ লাখ ১৮ হাজার ৮০০ কোটি টাকা।”
লকডাউন অবস্থা পুরো মে মাস এমনকি জুন মাসেও অব্যাহত থাকতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করে তিনি বলেন, “যদি তাই হয় তাহলে মে মাস শেষে অনুমিত ক্ষতির পরিমাণ দাঁড়াবে ২ লাখ ১৭ হাজার ৮০০ কোটি টাকা, যা গত অর্থবছরের মোট দেশীয় উৎপাদনের প্রায় ৯ শতাংশ।”
সুপারিশ
লকডাউনের অর্থনৈতিক ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সরকারের প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়ন নিশ্চিতের পাশাপাশি নতুন নতুন উপায় খোঁজার পরামর্শ দিয়েছেন অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ।
তার মতে, এই অবরুদ্ধ দশা দীর্ঘস্থায়ী হলে বেশিরভাগ ছোট-খাটো ব্যবসা এবং ছোট পরিসরের উৎপাদক প্রতিষ্ঠান সহজে ঘুরে দাঁড়াতে পারবে না।
“ফলে অভ্যন্তরীণ অর্থনীতিতে ব্যাকওয়ার্ড লিঙ্কেজ ও ফরওয়ার্ড লিঙ্কেজ চেইন মারত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে, যার ফল সামগ্রিক উৎপাদন ব্যবস্থা ব্যাহত হবে।”
বাংলাদেশের রেমিটেন্সের বড় উৎস মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেও করোনাভাইরাসের বিস্তার ঘটায় প্রবাসী আয়েও ধস দেখছেন অধ্যাপক আব্দুল হামিদ।
এছাড়া বাংলাদেশের রপ্তানিমূখী তৈরি পোশাক শিল্প আরও বেশি প্রতিযোগিতার মুখে পড়বে বলে মনে করছেন তিনি। এই প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের ওপর গুরুত্ব আরোপ করেন এই গবেষক।
মে মাসের দ্বিতীয় সপ্তাহ নাগাদ বাংলাদেশে করোনাভাইরাসের হটস্পটগুলো ‘চিহ্নিত হয়ে যাবে’ বলে মনে করছেন অধ্যাপক হামিদ।
তিনি বলেন, “আমরা আশা করি, মে মাস শেষে অর্থনীতি ধাপে ধাপে উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে এবং সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করবে।
“যদি মে মাসের পরেও অর্থনীতি উন্মুক্ত করা সম্ভব না হয় তাহলে রাজস্ব আদায় এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধিসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে, যা কাটিয়ে উঠা অনেক কঠিন হতে পারে। ক্ষতি কাটিয়ে উঠার উপায়গুলো তাই আগে থেকেই খুঁজতে হবে।”
গেল বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে ডেঙ্গুর ক্ষয়ক্ষতিও প্রাক্কলন করেছিলেন একদল গবেষক।