বন্ধ হচ্ছে না শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি আদায়
পূবের হাওয়া ডেস্ক
প্রকাশিত হয়েছে : ২১ মে ২০২০, ৫:২০ অপরাহ্ণঅভিজিৎ ভট্টাচার্য্য::
অনিমেষ ভট্টাচার্য্যরে এক মেয়ে পড়ে রাজধানীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান ভিকারুননিসা নূন স্কুল অ্যান্ড কলেজে। স¤প্রতি মেয়ের টিউশন ফি পরিশোধ করতে হয়েছে। শুধু একমাসের নয়, এপ্রিল, মে এবং জুন তিনমাসের টিউশন ফি একসঙ্গে পরিশোধ করতে হয়েছে। করোনায় সবকিছু বন্ধ থাকলেও স্কুলে মেয়ের টিউশন ফি দিতে হয়েছে।শুধু ভিকারুননিসা নয়, রাজধানীর অধিকাংশ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এই দুঃসময়েও শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি নিয়ে নিচ্ছে। এতে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন অভিভাবকরা। তারা বলেছেন, করোনা ভাইরাসের প্রকোপে মানুষের জীবন ও জীবিকা যেখানে থমকে আছে সেখানে বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায় করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠছে। জীবিকা বন্ধ থাকায় মানুষের জমানো টাকাও ফুরিয়ে আসতে শুরু করার মধ্যেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের টাকা মেটাবেন কী করে-এই নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন তারা।
প্রসঙ্গত, গত ১৭ মার্চ থেকে বন্ধ রয়েছে দেশের সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। এর ফলে মার্চ, এপ্রিল মাসের টিউশন ফি-ও নিতে পারেনি বেশিরভাগ স্কুল-কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়। এখন মে মাসে এসে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বলছে, টিউশন ফি না পাওয়ায় শিক্ষকদের বেতন দেয়া যাচ্ছে না। কাজেই বাধ্য হয়ে টিউশন ফি নিতে হচ্ছে। এরকম পরিস্থিতিতে স¤প্রতি ঢাকা শিক্ষা বোর্ড থেকে এক আদেশে টিউশন ফি আদায়ে চাপ প্রয়োগ না করার জন্য প্রতিষ্ঠান প্রধানদের অনুরোধ জানানো হয়েছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো খুলে দিলে বা স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরে আসলে বকেয়াসহ মাসিক বেতন আদায়ের অনুরোধ জানানো হয় আদেশে। তবে গত ৯ মে এক ভার্চুয়াল অনুষ্ঠানে যোগ দিয়ে শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনি জানান, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান পুরোটাই টিউশন ফি-নির্ভর। আমি অভিভাবকদের অনুরোধ করব, তারা যেন টিউশন ফি এর ব্যাপারটা বিবেচনা করেন।
শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র জানিয়েছে, এরই মধ্যে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে বার্তা দিয়ে বলা হয়েছে, শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে টিউশন ফি আদায়ে চাপ দেয়া যাবে না। টিউশন ফি আদায় নিয়ে সবাইকে বার্তা দেয়ার পর যারা টিউশন ফি দিতে পারবেন, তারা তা দেবেন। যারা পারবেন না তাদেরকে চাপ দেয়া কিংবা তাদের কাছ থেকে ফি আদায় করা যাবে না।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বেসরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের মধ্যে যেসব প্রতিষ্ঠান এমপিওভুক্ত সেসব প্রতিষ্ঠানের খুব একটা সমস্যা হচ্ছে না। কারণ এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে সরকার থেকেই প্রায় শতভাগ বেতন দেয়া হয়। তবে শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি না পাওয়ায় এমপিওভুক্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরা স্ব স্ব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে যে সম্মানী পেতেন সেটা বন্ধ আছে। শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি না পাওয়ায় আংশিক এমিপওভুক্ত কিংবা এমপিওভুক্ত নয় এমন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সংকটে পড়েছে। কারণ এসব প্রতিষ্ঠানে শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন হয় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি থেকেই। এখন টিউশন ফি বন্ধ থাকায় এসব প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক কর্মচারীদের বেতন ভাতা দেয়া বন্ধ আছে। এমন পরিস্থিতি উত্তরণেই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো টিউশন ফি চেয়ে নোটিশ পাঠিয়েছে।
গত ১২ মে রাজধানীর অন্যতম শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের অধ্যক্ষ ড. শাহান আরা বেগম স্বাক্ষরিত নোটিশ জারি করে বলা হয়েছে, ‘এতদ্বারা আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সম্মানিত অভিভাবক এবং শিক্ষার্থীদের অবগতির জন্য জানানো যাচ্ছে যে, করোনা ভাইরাসের কারণে সরকারি নির্দেশে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীদের টিউশন ফি অনলাইনে ডাচ বাংলা ব্যাংক লিমিটেডের রকেট কিংবা নেক্সাসপে’র মাধ্যমে আদায়ের সিদ্ধান্ত নিয়েছে গভর্নিং বডি। এবিষয়ে শ্রেণি শিক্ষকবৃন্দ সংশ্লিষ্ট সকলকে অবহিত করবেন।’
রাজধানীর মনিপুর উচ্চবিদ্যালয় থেকে সব অভিভাবকের কাছে টিউশন ফি পরিশোধের নোটিশ দেওয়া হয়েছে। নোটিশে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতন-ভাতা পরিশোধ করার জন্য বন্ধের মধ্যেও টিউশন ফি পরিশোধের অনুরোধ জানানো হয়েছে।
সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, করোনার কারণে উভয় সংকটে এখন এই শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো। প্রতিষ্ঠান কর্তৃপক্ষ টিউশন ফি চাইলে সেটা অমানবিক হয়। আর বেশির ভাগ অভিভাবকও এই মুহূর্তে বেতন দিতে রাজি নন। তবে প্রতিষ্ঠানগুলো টিউশন ফি আদায় না করলে শিক্ষক-কর্মচারীদের বেতনও দিতে পারছে না। আবার শিক্ষকদের বেতন-বোনাস বাকি পড়লে সেটাও অমানবিকতার পর্যায়ে পড়ে। এর ফলে অনেক প্রতিষ্ঠানই মানবিক আবেদনের মাধ্যমে এসএমএস পাঠিয়ে বেতন চাচ্ছে।
রাজধানীর রূপনগর মডেল স্কুল অ্যান্ড কলেজেও বেতন-ভাতা বন্ধ হয়ে আছে। একাধিক শিক্ষক জানিয়েছেন, বেতন-ভাতা বন্ধ থাকায় তাদের জীবনযাপনে কষ্ট হচ্ছে। প্রতিষ্ঠানটি সরকারি হয়েছে। কিন্তু শিক্ষক-কর্মচারীদের চাকরি আত্তীকরণ না হওয়ায় বেসরকারিভাবেই তাদের বেতন ভাতা হচ্ছে।
গত ১৭ মার্চ স্কুল বন্ধ হওয়ার পরপরই ঢাকার রামকৃষ্ণ মিশন উচ্চবিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক ঢাকা ছেড়ে বাড়ি চলে যান। তার বাড়ি উত্তরবঙ্গে। তিনি ঢাকায় একটি মেস বাড়িতে থাকতেন। কিন্তু দীর্ঘদিন স্কুল বন্ধ থাকায় গত পয়লা মে সেই মেসবাড়িটি ছেড়ে দেন। মেসবাড়ির অন্য বাসিন্দারা এর কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, স্কুল বন্ধ। বেতনও নেই। টিউশনিও নেই। ফলে আয়ের পথ বন্ধ। এছাড়া আমি নিজে ঢাকায় নেই। শুধুশুধু কেন মেসবাড়ির ভাড়া পরিশোধ করব। তারচেয়ে মেসবাড়ি ছেড়ে দিলাম। পরিস্থিতি স্বাভাবিক হলে ঢাকায় এসে স্কুলে ফের যোগদান করব।
এদিকে, সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের সমস্যা নেই। তবে বর্তমানে অর্ধলাখ কিন্ডারগার্টেন স্কুল রয়েছে। শিক্ষকরাও সামান্য টাকা বেতন পান। কিন্তু মার্চ মাস থেকেই এসব স্কুলের শিক্ষকদের বেতন বন্ধ রয়েছে। তারা চরম আর্থিক সংকটে রয়েছেন। তারা সরকারের কাছে আর্থিক সাহায্য চেয়েছিলেন। কিন্তু প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন সাফ বলেছেন, আপাতত কিন্ডারগার্টেন স্কুলের শিক্ষক-কর্মচারীর বিষয়ে ভাবছি না।
এছাড়াও দেশে ১০৫টি বেসরকারি বিশ^বিদ্যালয় রয়েছে। বড়ো পাঁচ-সাতটি বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের বড়ো অংকের ফান্ড রয়েছে। কয়েকমাস বিশ্ববিদ্যালয় বন্ধ থাকলেও তাদের চলতে সমস্যা হওয়ার কথা নয়। কিন্তু বাকিগুলো মাসে মাসে আদায়কৃত টিউশন ফি দিয়েই চলে। কিন্তু মার্চ মাস থেকে টিউশন ফি আদায় বন্ধ থাকায় তারাও বেশ সমস্যায় রয়েছেন।